ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ পাচার একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বর্ণের আন্তর্জাতিক বাজারে ভারত বর্তমানে দ্বিতীয় বৃহত্তম ভোক্তা দেশ, যেখানে বার্ষিক স্বর্ণের চাহিদা অন্তত এক হাজার টন। বিশেষ করে বিয়েসহ বিভিন্ন উৎসবের মৌসুমে শীতকালে এই চাহিদা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। দেশটিতে উচ্চ শুল্ক আরোপের ফলে ব্যবসায়ীদের জন্য বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি করা হয়ে দাঁড়িয়েছে কষ্টকর। এ কারণে, পাচারকৃত স্বর্ণের বৃহত্তম গন্তব্য হিসেবে ভারত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সম্প্রতি বেঙ্গালুরুভিত্তিক সেন্ট জোসেফস ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট এবং পন্ডিচেরি ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখা গেছে, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে স্বর্ণ পাচারের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এই গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, ভারতীয় শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্সের তথ্য অনুযায়ী, এই সময়কালে স্বর্ণ পাচার বৃদ্ধি পায়। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর সদস্যরাও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।
বিজিবির মুখপাত্র কর্নেল মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম জানিয়েছেন, শীতকালে কুয়াশার কারণে চোরাকারবারিরা বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে, বিজিবি সীমান্তে পাচারের সময় ৫৯৪ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে, যার ৪৪ শতাংশ গত বছর আটক হয়েছে। ২০২৩ সালে, প্রায় ২৬০ কেজি স্বর্ণ আটক হয়েছে, যার মধ্যে অক্টোবরে ১৪ কেজি, নভেম্বরে ২৭ কেজি এবং ডিসেম্বরে ১১ কেজি স্বর্ণ জব্দ হয়।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্বর্ণ পাচারের প্রভাবও মারাত্মক। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বর্ণ পাচার বাড়লে ব্যাংক ও কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে, দেশের কার্ব মার্কেটে ডলারের মূল্য স্থিতিশীল হলেও, আগস্টের শেষের দিকে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় হার ছিল ১২০ টাকা। চলতি মাসের শুরুতে তা বেড়ে ১২৪-১২৫ টাকার মধ্যে পৌঁছেছে।
এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশও বর্তমানে স্বর্ণের আকারে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। শুল্ক হার দ্বিগুণ করলেও, এই প্রবাহ বন্ধ করা যায়নি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার মূল্যের স্বর্ণের বার বৈধ করা হয়েছে। বৈধ পথে আসা স্বর্ণের তুলনায় অবৈধ পথে অনেক বেশি স্বর্ণ প্রবাহিত হচ্ছে।
যশোর ও খুলনা বিভাগের সীমান্তবর্তী জেলা গুলো এখন ভারতে স্বর্ণ পাচারের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। যশোরে গত চার বছরে ২৫০ কেজি স্বর্ণ জব্দ হয়েছে। স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানাচ্ছেন, বর্ষা মৌসুমে পানি জমে থাকার কারণে চোরাকারবারিরা শুষ্ক মৌসুমে বেশি তৎপর হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার সমপরিমাণ স্বর্ণ পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেছেন, “বিগত সরকারের সময়ে স্বর্ণ পাচার ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”
এদিকে, সীমান্তে স্বর্ণ পাচার রোধে বিজিবির গোয়েন্দা দল কাজ করছে। তবে প্রশ্ন উঠছে, এই চোরাচালান রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে কিনা। সরকারের নীতিগত পরিবর্তন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বর্ণ পাচার একটি অব্যাহত সংকট হয়ে দাঁড়াতে পারে।