বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। দেশের পোশাক শিল্প, রেমিট্যান্স এবং সামগ্রিকভাবে উৎপাদনশীল খাতগুলো দেশকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিণত করেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যবসার পরিবেশের সূচক নিম্নমুখী হওয়ায়, এই উন্নয়ন ধারা চাপের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের সূচক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একাধিক অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ এর অবনতির জন্য দায়ী।
বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশের সূচক:
বিশ্বব্যাংকের ” ডুয়িং বিজনেস” রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৮তম। এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন: ভারত (৬৩তম), ভুটান (৮৯তম) এবং নেপালের (৯৪তম) তুলনায় অনেক পিছিয়ে। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ (পিইবি) এর সূচক ২০২৩-২৪ অনুযায়ী, শূন্য থেকে ১০০ স্কেলে পরিমাপ করা দেশীয় সূচকে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ৫৮ দশমিক ৭৫ এ নেমে এসেছে, যা আগের বছর ৬১ দশমিক ৯৫ ছিল।
ব্যবসার পরিবেশ সূচক বা বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ২০২৩-২৪ জরিপে এমন চিত্রই উঠে এসেছে। জরিপের তথ্যানুযায়ী, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া গত এক বছরে ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ পাওয়া আরো কঠিন হয়েছে। কর ও ভ্যাট পরিশোধে হয়রানি রয়ে গেছে। ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া আরও বেশি জটিল হয়েছে। এ ছাড়া আইনকানুনের তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামো সুবিধা, শ্রম নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসায় বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ- যেমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং শিল্পায়ন প্রক্রিয়া চলমান থাকা সত্ত্বেও, সূচকের এই নিম্নমুখিতা ক্রমেই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসায়িক পরিবেশের এই সূচকের অবনতি দেশের ব্যবসায়িক উন্নয়নে নতুন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছে ।
অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জসমূহ:
বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশের অবনতির পেছনে বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ বিষয় কাজ করছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ হলো:
বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু থেকে তা পরিচালনা করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে বিভিন্ন প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। অনুমতি পেতে দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা, আইনগত জটিলতা এবং রাজস্ব সংগ্রহের সমস্যাগুলো ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
দুর্নীতি বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের একটি বড় সমস্যা। সরকারি ও বেসরকারি খাতের দুর্নীতির কারণে ব্যবসায় লাভবান হবার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে এবং দেশীয় ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে বাধা দিচ্ছে।
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, তবুও বিদ্যুৎ, পরিবহন এবং তথ্য প্রযুক্তি খাতে আরো উন্নয়ন প্রয়োজন।
বিশেষত: উল্লেখ করা যায়, বিগত সরকার পতনের আন্দোলনের অস্থিতিশীল সময়টাতে ইন্টারনেট সংযোগ দেশব্যাপী বন্ধ করে দেওয়ার কারণে ব্যবসায়িক পরিবেশ দারুন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিশেষ করে মাঝারি ও বৃহৎ ব্যবসায়ীরা ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হন।ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে দ্রুতগতির ইন্টারনেট, সড়ক ও রেলপথের উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের নিরবচ্ছিন্নতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। ক্রমবর্ধমান ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি দেশের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কৃষি খাত আমাদের দেশের অর্থনীতিতে সিংহভাগ ভূমিকা পালন করে এবং এ খাতও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা সরাসরি ব্যবসায়িক পরিবেশকে বিপর্যস্ত করছে। এ ক্ষতির পরিমাণ সাম্প্রতিককালের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি থেকেই অনুমান করা যায়।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাব:
বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশের অবনতির পেছনে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাবও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। যেমন: ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, যা বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলা ব্যাহত, আমদানি-রপ্তানি সংকট এবং স্থানীয় উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে দেশের ব্যবসা খাতগুলো কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে।
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বৃদ্ধির মূল কারণ, সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন ঘটা। যদিও রাশিয়া এবং ইউক্রেন নিজেরা তেল উৎপাদনকারী দেশ নয় (বিশেষ করে ইউক্রেন), তবে রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিকারক। যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে, যা বৈশ্বিক তেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে বাজারে তেলের সংকট সৃষ্টি হয়েছে, যা মূল্য বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধি কাঁচামালের মূল্যও বাড়িয়ে তুলেছে, যা ব্যবসার পরিবেশকে জটিল করেছে। বিশেষ করে পোশাক খাতের মতো আমদানি নির্ভর খাতগুলো সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য দ্বন্দ্বের প্রভাবও বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে পড়েছে। এই দ্বন্দ্বের ফলে বৈশ্বিক বাজারে অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত বিশেষত: পোশাক শিল্পে বিদেশি অর্ডার কমে যাওয়াসহ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা সংকট দেখা দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরাও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের বাজারে বিনিয়োগ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছেন। এর ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে এবং স্থানীয় ব্যবসায়িক কার্যক্রমে দুর্বলতা দেখা দিচ্ছে।
সমাধানের পথ:
বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি করতে এবং বৈশ্বিক প্রভাব মোকাবেলা করতে সরকার এবং বেসরকারি খাতের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ব্যবসায়িক পরিবেশের সংকটের সম্ভাব্য সমাধানগুলো হলো:
ব্যবসা শুরু এবং পরিচালনার প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। এর মাধ্যমে লাইসেন্স পাওয়ার জটিলতা ও সময় কমানো, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং আইনি প্রক্রিয়া সহজ করা যেতে পারে। এর উদ্যোগ প্রধানত প্রশাসন বা সরকারকেই নিতে হবে।
দুর্নীতির মাত্রা কমিয়ে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে হবে। সুশাসনের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য সাধারণ নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে সমাজের প্রত্যেকটি স্তর থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।
বৈশ্বিক মন্দা এবং বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব মোকাবেলা করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করা প্রয়োজন। বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে হবে। এজন্য সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কে আরো সচেতন ভাবে সুপরিকল্পনার সাথে কাজ করতে হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ বান্ধব অবকাঠামো তৈরি এবং ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্ট প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে ব্যবসার পরিবেশকে আরো টেকসই করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবেশ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়কে ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাংলাদেশের ব্যবসা পরিবেশের সাম্প্রতিক অবনতি একটি বহুস্তরীয় ও জটিল বাস্তবতার প্রতিফলন। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সরবরাহ শৃঙ্খলের বিঘ্ন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রতিফলিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যে বাধাগুলো সৃষ্টি হয়েছে, তা অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাগুলোর সাথে একত্রে মিলে ফলস্বরূপ বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ ক্রমশ নাজুক করে তুলেছে।
তবে, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের উচিত দক্ষ নীতিগত সংস্কার, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং বহুমুখী বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বৈশ্বিক রপ্তানি বাজারে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারলে, বাংলাদেশ ভবিষ্যতে পুনরায় একটি স্থিতিশীল ও উন্নয়নমুখী ব্যবসা পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হবে।