মধ্যপ্রাচ্য – যা একসময় ছিল সভ্যতার সূতিকাগার। আজ বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি ভূখণ্ড হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই অঞ্চলের অগাধ প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে তেল, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী শক্তিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কেননা, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝির দিকে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে তেলের খনি আবিষ্কৃত হওয়ার পরে মূলত যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা মিত্র বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। এর আগে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমাদের সম্পর্ক বা কোন ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য ছিল না। তবে শুধুমাত্র তেলের জন্যই কি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে এত গভীর আগ্রহ? নাকি এর পেছনে রয়েছে আরও গভীর কৌশলগত এবং সামরিক কারণ?
মূলতঃ জ্বালানি সম্পদ, বাণিজ্য রুট , ভূ- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা ও ইসরাইলের সঙ্গে দেশটির স্থায়ী মিত্রতার মত বিষয়গুলোকেই অঞ্চলটির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণ হিসেবে দেখে থাকেন বিশ্লেষকরা। মধ্যপ্রাচ্য একদিকে একটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক অঞ্চল, অন্যদিকে এটি আধুনিক যুগের ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এখানে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল মজুদ কয়েক দশক ধরেই মার্কিন নীতি নির্ধারণের একটি প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। এছাড়া ও আরো অনেক ব্যবসা আছে এ অঞ্চলে। বিশ্বের জ্বালানি তেলের ৪৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় এ অঞ্চলে। আবার বিশ্বের যত তেল রপ্তানি হয়, তার ৪৬ শতাংশ হয় মধ্যপ্রাচ্য থেকে। প্রাকৃতিক গ্যাসের ২২ শতাংশ এবং তরলকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ৩০ শতাংশ আসে এই অঞ্চল থেকে। তেল ও গ্যাসের বিপুল মজুদও আছে মধ্যপ্রাচ্যে। বিশ্বের মোট তেলের ৫২ শতাংশ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪৩ শতাংশের মজুদ এ অঞ্চলে। ১৯৭৩ সালের তেল সংকট এবং পরবর্তী বছরগুলোতে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই অঞ্চলের তেলের বাজারের স্থিতিশীলতা বিশ্বের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মধ্যপ্রাচ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমন: মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্ব মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ইউরোপ, আফ্রিকা এবং রাশিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। এটি মার্কিন বাণিজ্য ও সামরিক অভিযানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাহরাইন, কাতার এবং কুয়েতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেখানে কতটি ঘাঁটি ও সেনা রয়েছে তার সঠিকভাবে জানা না গেলেও অনুমান করা যায় সেখানে তাদের ১০ টি ঘাঁটি ও প্রায় ৪৫ হাজার সেনার অবস্থান রয়েছে। কোন একক শক্তি যেন আধিপত্য বিস্তার করে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে হুমকির দিকে ফেলতে না পারে তা নিশ্চিত করতে নিজেকে শক্তিশালী অবস্থানে বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র ।
১৯৯০ সালের দশক থেকে সন্ত্রাসবাদ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার একটি প্রধান উদ্যোগের বিষয় হয়ে উঠেছে। আল – কায়েদা ( জন্ম ১৯৮৮ সাল), আইএস (জন্ম ২০০৪ সাল) এর মতো সংগঠন গুলোর জন্ম এবং কার্যক্রম মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হবার পর থেকে সন্ত্রাসী দমনের নাম করে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার অবস্থান-প্রসারিত করেছে। যদিও আল-কায়েদাকে ধ্বংস করার জন্য মার্কিন যুদ্ধের বেশিরভাগই আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে ও তারা তাদের কার্যক্রম ও জোটগত তৎপরতা চালিয়ে গেছে। এছাড়া ও এ অঞ্চলটি হামাস ও হিজবুল্লাহসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ কর্তৃক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত ও নিষিদ্ধ আরো কয়েকটি গোষ্ঠীর আবাসস্থল।
আর অতি সম্প্রতি মার্কিন সমর্থিত একটি বৈশ্বিক জোট সিরিয়া ও ইরাকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ইসলামিক গোষ্ঠীকে তাড়িয়ে দিতে স্থানীয় বাহিনীকে সমর্থন করেছে। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন সন্ত্রাসবাদ দমনের চেষ্টা করে তারা কোন মতেই সন্ত্রাসবাদের মূল কারণগুলোর সমাধান করে না। কিন্তু তারা সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে ঠিকই সেখানে সশস্ত্র কাজকর্মে লিপ্ত রয়েছে, যা তাদের মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানকে আরো প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আবার মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক খেলোয়াড়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা একটি কৌশলগত উপায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা প্রদান করে এবং এর আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, আরব- ইসরায়েল সম্পর্কের উন্নতি এবং শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যার প্রমাণস্বরূপ ২০২০ সালের আব্রাহাম চুক্তির কথা উল্লেখ করা যায়। বর্তমানে গাজা যুদ্ধে ইসরাইলের নিষ্ঠুরতা ও জঘন্য কৌশল অবলম্বন। দুই দেশের লক্ষ্য নিয়ে মতভেদের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে গুরুতর ও ক্রমবর্ধমান পার্থক্য সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটি পর্যায়ে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের জন্য দেশটি সামরিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করে যাচ্ছে।
আবার, মধ্যপ্রাচ্য একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র। মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকান পণ্য ও পরিষেবা বিশেষ করে সামরিক হার্ডওয়্যারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাজার। ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এ অঞ্চলটিতেই সবচেয়ে বেশি মার্কিন অস্ত্র রপ্তানি করা হয়েছে। মার্কিন অস্ত্র রপ্তানির ৫০ শতাংশই আসে মধ্যপ্রাচ্যে। যার মধ্যে ৩০ শতাংশই এককভাবে সৌদি আরব ক্রয় করে । উল্লেখ্য, ইয়েমেনে সৌদি আরবের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের কারণে সারা বিশ্বে তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রির নিষেধাজ্ঞা উঠলেও কেবল অস্ত্র বিক্রির লাভের কারণে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির কাছে অস্ত্র রপ্তানির উপর কোন নিষেধাজ্ঞা এ পর্যন্ত দেয়নি।
এছাড়া ও সমুদ্রপথে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ অবস্থানগত কারণে মধ্যপ্রাচ্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবছর ১৭ হাজারেরও বেশি জাহাজ লোহিত সাগর দিয়ে খাবার, ঔষধ ,জ্বালানি সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন করে থাকে। যা বিশ্বে বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ। এ অঞ্চলের মিশরের সুয়েজ খাল ও ইরাকের অদূরে হরমুজের সরু প্রণালী ও অত্যন্ত জরুরি। এই বৈশ্বিক সমুদ্রপথ মার্কিন অর্থনীতির জন্য এখনো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায়ই এ অঞ্চলের সাগরে নিজেদের বিভিন্ন রণ তরী ও যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে তাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে দেখা যায়।
মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মানবিক সংকট বিদ্যমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন মানবিক সহায়তা এবং উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এই অঞ্চলের জনগণের কল্যানে সহযোগিতা করে থাকে। যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং দুর্ভিক্ষের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাহায্য করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এনজিওর মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু তাদের এ মানবিক কাজগুলো তাদের এ অঞ্চলকে দখলে রাখার কৌশল হিসেবেই গণ্য করা হয়।
উপরোক্ত আলোচনা বিশ্লেষণ করলে একথা স্পষ্ট হয় যে, মধ্যপ্রাচ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কেবল একটি ভূ- রাজনৈতিক অঞ্চল নয় বরং একটি কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তামূলক গুরুত্ব বহন করে। তেলের রিজার্ভ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা, ইসরায়েল-আরব সম্পর্ক এসবই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আধিপত্য বিস্তারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবাহী উপাদান। মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির আগ্রহ মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের তাদের সারা বিশ্বে প্রভাব বজায় রাখার পরিকল্পনা হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। এই অঞ্চলের ভূমিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নীতির একটি অপরিহার্য অংশ। তাই মধ্যপ্রাচ্যের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এবং এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা ও অর্থনীতি স্থিতিশীলতার জন্য অনস্বীকার্য।