বিয়ে একটি পবিত্র সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন। ভারতীয় উপমহাদেশে বিয়ে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ও আড়ম্বরতার সাথে পালন করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশ যেন বেশি এগিয়ে রয়েছে । বিশেষ করে ভারতীয় বিয়ে কেবল একটি সামাজিক অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং পারিবারিক মর্যাদার প্রতীকও। তবে বিয়ের ব্যয়বহুলতা বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে যখন সাম্প্রতিককালে ভারতীয় শীর্ষ ধনী আম্বানি পুত্রের বিয়ে বাজেট সকলের অনুমান ছাড়িয়ে যায় ।
ভারতের বিয়ে ঐতিহ্যগতভাবে একটি বিশাল অনুষ্ঠান। বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ের ধরন ও রীতি আলাদা হলেও, সবার মধ্যে সাধারণ একটি বিষয় হল ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি ও খরচ। বিয়েতে প্রচুর খরচের মূল কারণ হলো এটি একটি পরিবার এবং সমাজের মর্যাদার বিষয়। পারিবারিক মর্যাদা রক্ষা করতে এবং সামাজিক অবস্থান জোরদার করতে অনেকেই বিয়ের অনুষ্ঠানে বিলাসিতা ও অতিরিক্ত খরচ করেন।
ধনী আম্বানি পরিবারের বিয়ে: একটি মহাসমারোহ –
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক, ধনী শিল্পপতি মুকেশ আম্বানির পরিবার, ভারতের সবচেয়ে বিলাসবহুল বিয়ের উদাহরণ। তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোর বর্ণনা সংবাদপত্র ও মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হয়। উদাহরণস্বরূপ- সাম্প্রতিক কালে মুকেশ আম্বানি পুত্র অনন্ত আম্বানির বিয়েতে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। যা ছিল এ শীর্ষ ধনী ব্যক্তির মোট সম্পদের মাত্র ০.৫% শতাংশ। দুইটি প্রিওয়েডিং অনুষ্ঠান এবং এ বিয়ের মূল অনুষ্ঠান মিলে প্রায় সাত মাস ধরে চলে এই বিয়ের আয়োজন। এই বিশাল খরচের পিছনে ছিল একটি আন্তর্জাতিক মানের অনুষ্ঠান, যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তারকারা অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বিলাসবহুল ভেন্যু, কস্টিউম, খাদ্য এবং অন্যান্য বিশিষ্ট সুবিধা ছিল। অনন্ত আম্বানি ও রাধিকা মর্চেন্টের বিয়ের মূল অনুষ্ঠান ২০২৪ সালের ১২ই জুলাই অনুষ্ঠিত হয়। এই বিয়েটি ছিল ভারতের অন্যতম বিলাসবহুল এবং জাঁকজমকপূর্ণ একটি আয়োজন। মুম্বাইয়ের আইকনিক এন্টালিয়া ভবনকে এই বিবাহের মূল ভেন্যু হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আম্বানি পরিবারের ধনী ও অভিজাত জীবনযাত্রার প্রতিফলন দেখা যায় এই অনুষ্ঠানের প্রতিটি দিকেই।
বিয়ের প্রাক্কালে অচিন্তনীয় বিলাসিতার সাথে দুইটি প্রি-ওয়েডিং অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। যেমন: মেহেদী, সঙ্গীত ও গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান ছিল বিলাসিতা ও রাজকীয়তার অনন্য উদাহরণ। সঙ্গীত অনুষ্ঠানের জন্য আয়োজিত হয়েছিল উচ্চমানের বিনোদন। যেখানে বলিউড তারকাদের পারফর্মেন্স থেকে শুরু করে অভিজাত মিউজিক্যাল শো ছিল এক বিশেষ আকর্ষণ।
এছাড়া বিয়েতে ব্যবহৃত গয়নাগুলো ছিল বিশ্বমানের ডিজাইন ও রত্নপাথরে সাজানো। কনের পরিহিত পোশাকটি ডিজাইন করেছিলেন শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন ডিজাইনাররা এবং এর মূল্যও ছিল চমকপ্রদ। অতিথিদের জন্য আম্বানি পরিবার বিশ্বের সেরা পাঁচ তারকা হোটেলে বিলাসবহুল আবাসনের ব্যবস্থা করে। খাবারের জন্যও আয়োজিত হয়েছিল বিভিন্ন দেশের অভিজাত রন্ধনশিল্পীদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত বিশ্বমানের খাবার। এর মধ্যে ছিল দেশি-বিদেশি প্রায় ২৫০০টি পদেরও বেশি নিরামিষ খাবার।
এ ধরনের অনুষ্ঠান শুধুমাত্র একটি পরিবারের আয়ের ক্ষমতা প্রদর্শন করে না বরং সামাজিক মর্যাদা ও প্রভাব বৃদ্ধির একটি উপায় হিসেবে দেখা হয়। বড়লোকদের জন্য এই ধরনের খরচ একটি স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে কাজ করে।
ঋণগ্রস্ত থেকে সাধারণ পরিবার- ভারতের অনেক গরীব ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে বিয়েতে অতিরিক্ত খরচের চাপ মোকাবেলা করতে হয়।
ফলে অনেক পরিবার বিয়ের জন্য ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ঋণের বোঝা বহন করতে গিয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবনের গুণগত মান হ্রাস পায়। বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় খরচের মধ্যে রয়েছে বিয়ের আয়োজন, কনের পোশাক, পুরস্কার, খাবার, অতিথিদের জন্য বিলাসবহুল সুবিধা ইত্যাদি।
ভারতের অনেক পরিবার, সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করতে এবং প্রতিবেশীদের চোখে ভালভাবে প্রদর্শিত হতে এই অতিরিক্ত খরচের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়। এ কারণে তারা অনেকে ঋণ নিয়ে অথবা নিজেদের সঞ্চিত অর্থ খরচ করে বিয়ে সম্পন্ন করে।
ভারতের বিয়েতে খরচের একটি বড় কারণ হলো সামাজিক চাপ। প্রতিটি পরিবারের জন্য বিয়ে একটি বৃহৎ সামাজিক অনুষ্ঠান, যা তাদের মর্যাদা এবং সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ করে। বিশেষ করে, যখন একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা চলে, তখন অনেকেই অতিরিক্ত খরচ করতে বাধ্য হন। পরিবারের সদস্যরা, বন্ধু ও প্রতিবেশীরা কেমন বিয়ে আয়োজন করছেন, তার উপর নির্ভর করে তাদের সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান প্রভাবিত হয়। বিয়ের খরচ বাড়ানোর জন্য পারিবারিক মর্যাদা বৃদ্ধি, সামাজিক সম্মান অর্জন এবং সমাজের প্রতি প্রভাব বিস্তার করতে অনেকেই ব্যয়বহুল উপায় বেছে নেন। এতে করে শুধু অর্থনৈতিক চাপই বাড়ে না, পারিবারিক সম্পর্কেও পরিবর্তন আসতে পারে।
তবে বর্তমানে, অনেকেই বিয়ের খরচ কমানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। কিছু পরিবার ছোট আকারের এবং সাধারন অনুষ্ঠান আয়োজন করে এবং সামাজিক চাপের বাইরে এসে অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল থাকার চেষ্টা করছেন। এছাড়া সামাজিক মিডিয়া এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিয়ের খরচ কমানোর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রচার করা হচ্ছে। এছাড়া, সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যেমন-বিয়ের খরচের ওপর কর সুবিধা এবং ঋণ সহায়তা প্রদান। এই পদক্ষেপগুলি পরিবারগুলোকে অতিরিক্ত চাপ থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করতে পারে।
ভারতের বিয়ের খরচের পেছনে যে বিশাল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাপ রয়েছে, তা ধনী আম্বানি পরিবারের মহাসমারোহ থেকে শুরু করে ঋণগ্রস্ত বাবার চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি একটি সমাজের অবস্থান ও মর্যাদা প্রতিস্থাপন করা এবং পরিবারের দায়িত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখা হয়। তবে, সামাজিক চাপের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপের মুখে থাকার কারণে বিয়ের খরচ কমানোর জন্য সচেতনতা ও উদ্যোগ অত্যন্ত প্রয়োজন। শুধু তখনই পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদার মাঝে একটি সুষম ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে।