প্লাস্টিক দ্বারা তৈরি জিনিসপত্র কমদামী ও সস্তা হওয়ায় প্লাস্টিক ব্যবহার অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে আধুনিক শিল্পায়ন ও নগরায়নে। প্লাস্টিক আজ দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু এর বর্জ্যও পরিবেশের জন্য বিপদজনক একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু প্লাস্টিকের বর্জ্য যা একসময় পরিবেশের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হতো, এখন তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন কয়েক হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, যা সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে পরিবেশে জমা হয়ে মারাত্মক দূষণ ঘটাচ্ছে। কিন্তু এই বর্জ্যকে সঠিকভাবে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হলে তা দেশের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন পণ্য তৈরি, শিল্পক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং রপ্তানির পরিধি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এ দূষণকারী উপাদানকে যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তা দেশের উন্নয়নের একটি বড় চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশে প্লাস্টিক বর্জ্যের বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার গত কয়েক দশকে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৬৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যা দেশের মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় ৩৬%। সারা দেশে দৈনিক প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ প্রায় ১৮০০ টন। এই প্লাস্টিকের একটি বড় অংশই যথাযথ পুনর্ব্যবহারের বাইরে থেকে যায় এবং প্রায় ৮% প্লাস্টিক কোনো প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই খোলা পরিবেশে নিক্ষিপ্ত হয়, যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশে ১৯৯০-এর দশক থেকেই প্লাস্টিকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে। শহরাঞ্চলে প্যাকেজিং, গৃহস্থালী পণ্য, ইলেকট্রনিক সামগ্রী এবং ফার্নিচারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের চাহিদা বেড়েছে। বর্তমানে একজন শহুরে বাসিন্দা বছরে গড়ে ১৭-২০ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করে, যেখানে ২০০৫ সালে এই পরিমাণ ছিল ৩-৫ কেজি।
দেশের শিল্পখাতে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা ক্রমেই অপরিসীম হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্লাস্টিক পুনঃব্যবহারের হার এখনো মাত্র ৩৬%। বাকি বর্জ্য যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে পরিবেশ দূষণ এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, সঠিক নীতিমালা, কারিগরি উন্নয়ন এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের বাজার তৈরি করলে এই চিত্র বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্লাস্টিক বর্জ্য যেভাবে কাজে লাগতে পারে অর্থনৈতিক উন্নয়নে
প্লাস্টিক বর্জ্যকে অর্থনৈতিকভাবে কাজে লাগানোর অন্যতম সফল মডেল হলো পুনঃব্যবহার। উন্নত দেশগুলো ইতোমধ্যেই প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, এবং সুইডেনের মতো দেশগুলো প্লাস্টিক বর্জ্য পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক লাভ দুটিই অর্জন করছে। এর মধ্যে জার্মানি অন্যতম। দেশটি ২০১৯ সালে তার মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় ৫৬% পুনর্ব্যবহার করেছে, যা বিশ্বের শীর্ষ স্থানে রয়েছে। জার্মানির এই সাফল্যের প্রধান কারণ হলো তাদের ‘ডুয়েল সিস্টেম’, যেখানে প্রতিটি পরিবারের জন্য আলাদা রিসাইক্লিং বিন স্থাপন করা হয় এবং পুনর্ব্যবহৃত পণ্যের আলাদা শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। এছাড়াও, সরকার কঠোর আইন প্রণয়ন করে শিল্পকারখানাগুলোকে পুনঃব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যবহারে বাধ্য করছে।
বাংলাদেশ এই মডেল থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। যথাযথ বিন্যাস ও প্রযুক্তির মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্যের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব।আমাদের দেশে এখনও বহু প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের বাইরে থেকে যায়, যা সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
প্লাস্টিক বর্জ্যকে পুনঃব্যবহার করে জ্বালানি উৎপাদন করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক ধারণা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পলিথিন ও অন্যান্য প্লাস্টিকজাত পণ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে পেট্রোলিয়ামজাত জ্বালানি উৎপাদনের প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশে সফলভাবে প্রয়োগ হচ্ছে। বাংলাদেশেও এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করা সম্ভব হলে দেশের জ্বালানি সংকট মোকাবিলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হতে পারে। যেমন, থার্মাল ডিপোলিমারাইজেশন নামে একটি প্রযুক্তির মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্যকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে জ্বালানি উৎপাদন করা সম্ভব, যা গ্যাস, ডিজেল ও কেরোসিনের বিকল্প হতে পারে। এই উদ্যোগগুলো দেশের জ্বালানি খাতে এক নতুন সম্ভাবনা যোগ করবে, যা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থান তৈরি করবে।
প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের আরেকটি বড় সম্ভাবনা হলো বিভিন্ন শিল্প খাতে এর ব্যবহার। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে রাস্তাঘাট নির্মাণে ব্যবহৃত উপাদান, আসবাবপত্র, এবং নির্মাণ সামগ্রী তৈরি করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, উন্নত দেশে প্লাস্টিক বর্জ্যকে রাস্তায় বিটুমিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা দীর্ঘস্থায়ী এবং পরিবেশবান্ধব। বাংলাদেশে রাস্তাঘাটের নির্মাণেও এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সাশ্রয় এবং পরিবেশগত উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।
প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়াটি শুধু পরিবেশগত উন্নতির জন্য নয়, বরং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং পুনঃব্যবহারের কাজগুলোতে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এটি একটি নতুন উপার্জনের পথ দেখাবে।এছাড়া, নতুন উদ্যোক্তারা এই শিল্পে বিনিয়োগ করে লাভজনক ব্যবসা গড়ে তুলতে পারেন। সঠিক প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করা হলে এই খাতটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
তবে, বাংলাদেশে প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে কয়েকটি বড় বাধাও রয়েছে। প্রথমত, দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিক ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি, যা প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করবে। দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে, যার ফলে তারা প্লাস্টিক বর্জ্য আলাদা করে ফেলছে না। যেমন উন্নত দেশে পচনশীল বর্জ্য এবং প্লাস্টিক বর্জ্য আলাদা করে ফেলা হয় যাতে তাদের পরিবেশের কোন ক্ষতি না হয় এবং বর্জ্য গুলো কাজে লাগানো বা সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। তৃতীয়ত, পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি খুব সীমিত, আর এই খাতে বিনিয়োগের অভাব রয়েছে। এছাড়া, সরকারের আইন ও নীতিমালা ঠিকমতো কার্যকর না হওয়ায় পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়া আরো কঠিন হয়ে পড়েছে।
মূলত প্লাস্টিক বর্জ্য একদিকে যেমন পরিবেশগত সংকট তৈরি করছে, তেমনি অন্যদিকে এটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটি নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। এ অবস্থায় প্লাস্টিক আমাদের অর্থনীতিতে সাপে বর হতে পারে।পুনর্ব্যবহার এবং পুনঃব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করে বাংলাদেশ এই খাত থেকে অনেক অর্থনৈতিক সুবিধা পেতে পারে। পরিবেশ রক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন একসঙ্গে অর্জনের জন্য প্লাস্টিক বর্জ্যকে এখন সম্পদে রূপান্তরিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের যথাযথ নীতি, উদ্যোক্তা সৃষ্টি, এবং জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে বাংলাদেশ প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি মডেল দেশে পরিণত হতে পারে।