বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে স্থগিত বৈদেশিক ঋণের স্থিতি কমতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি ব্যাপকভাবে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে চলতি বছরের জুলাই মাসে ৮৬ কোটি ৭৪ লাখ ডলার থেকে সেপ্টেম্বরে ঋণের স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ৬৮ কোটি ৮৫ লাখ ডলারে। যা স্থানীয় মুদ্রায় ৮ হাজার ২৬২ কোটি টাকার সমান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, করোনাকালে এবং পরবর্তী সময়ে ডলার সংকটের কারণে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিশোধ যথাসময়ে করা সম্ভব হয়নি। তাই একাধিকবার ঋণের পরিশোধের সময় বাড়ানো হয়েছে, যার ফলে ঋণের স্থিতি বেড়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য হলো, এসব ঋণের সুদের হার এবং বিনিময় হার বাজারভিত্তিক। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধের সময় বাজারে কার্যকর হারে সুদ দিতে হয় এবং ডলারের মূল্যও বাজারের দামে পরিশোধ করতে হয়।
গত আড়াই বছরে ডলারের মূল্য গড়ে ৩৫ টাকা বেড়ে ৮৫ টাকার পরিবর্তে বর্তমানে ১২০ টাকা দাঁড়িয়েছে। এর ফলে ঋণের বিপরীতে প্রতি ডলার কিনতে ৩৫ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। সুদের হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে পূর্বে ৩ থেকে ৪ শতাংশ ছিল, বর্তমানে তা ৭ থেকে ৮ শতাংশে পৌঁছেছে। এই কারণে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের উপর দ্বিগুণ চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
বেসরকারি খাতে নেওয়া স্বল্পমেয়াদি ঋণের একটি বড় অংশ আমদানির বিপরীতে কিছু অংশ অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে নেওয়া হয়েছে। যা অনেক ক্ষেত্রে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে দেখা যায়, কিছু ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের ঋণ দিয়ে এলসি খোলা হলেও পণ্য দেশে আসেনি। ফলে গ্রাহকের নামে ফোর্স লোন তৈরি করে ব্যাংক বৈদেশিক ঋণ শোধ করেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণের পরিশোধের জন্য ডলারে ঋণ নেওয়া হয়েছে এবং পরিশোধের জন্যও ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার বাড়ার ফলে ব্যাংকগুলো বাড়তি সুদ পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছে।
জানা যায়, কিছু ঋণের বিপরীতে বাড়তি ফি বা কমিশনও পরিশোধ করতে হচ্ছে। ২০২০ সালে কমিশন বাবদ ৬৯ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। যা ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। ২০২২ সালে কমিশন বেড়ে ৩ কোটি ৭৭ লাখ ডলারে পৌঁছায়। ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ৭৯ লাখ ডলারে। এই চার বছরে বাংলাদেশকে ৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের কমিশন পরিশোধ করতে হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯১৫ কোটি টাকার সমান।
২০১৪ সালে স্থগিত বকেয়া ঋণের স্থিতি ছিল ৪০ কোটি ১১ লাখ ডলার। বিভিন্ন বছর ধরে এই স্থিতি বৃদ্ধি ও হ্রাস পেয়েছে, তবে ২০২০ সালে করোনার কারণে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা সম্ভব হয়নি। তখন ঋণের স্থিতি দ্বিগুণ বেড়ে ৬৬ কোটি ৪০ লাখ ডলারে পৌঁছায়। এরপর থেকে ঋণের স্থিতি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৭ কোটি ৮৯ লাখ ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে। ফলে সেপ্টেম্বরে ঋণের স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ৬৮ কোটি ৮৫ লাখ ডলারে। আশা করা হচ্ছে, চলতি মাসেও আরও ঋণ পরিশোধ হবে এবং স্থিতি আরও কমতে পারে।
এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে যা ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।