ইপিজেড বা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (Export Processing Zones) বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় উন্নয়নশীল দেশের শিল্পায়নের এক সফল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দ্রুত শিল্পোন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ১৯৮০-এর দশকে ইপিজেড ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে। ইপিজেডগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো, বিনিয়োগ সুবিধা এবং কর ছাড় প্রদান করে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা হয়, যা দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের ভিত্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক প্রেক্ষাপটে ইপিজেডগুলো শিল্প খাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। দেশীয় উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ইপিজেডগুলো শিল্প উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছে। তবে বিশ্বব্যাপী চাহিদা, বাজার প্রতিযোগিতা এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে তার ইপিজেড নীতিমালায় আধুনিকায়ন এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে।
ইপিজেড এর কাজ-
ইপিজেড-এর ধারণাটি ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আসে। এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে যখন উন্নয়নের নতুন মডেল প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তখনই ইপিজেড এর ধারণা আবিষ্কার করা হয়। মূলত বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইপিজেডের প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশে ইপিজেড-এর সূচনা ঘটে ১৯৮৩ সালে, এদেশে চট্টগ্রামে প্রথম ইপিজেড প্রতিষ্ঠিত হয়। বেপজা (বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি) এর তত্ত্বাবধানে বর্তমানে দেশে আটটি ইপিজেড পরিচালিত হচ্ছে, যার মধ্যে চট্টগ্রাম, ঢাকা, মংলা, উত্তরা এবং ইশ্বরদী ইপিজেড অন্যতম।
ইপিজেড মূলত বেপজা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক অঞ্চল। বাংলাদেশে সরকারি ৮ টি এবং বেসরকারি ২টি ইপিজেড রয়েছে। রপ্তানিযোগ্য যেকোন পণ্য এখানে উৎপাদিত হয়, তবে বেশিরভাগ ইপিজেডএ তৈরি পোশাক শিল্পের উৎপাদন হয়। এছাড়া চামড়াজাত পণ্য, ব্যাগ, জুতা, কম্বল, খেলনাসামগ্রী, ফেব্রিক্স ও ইয়ার্ন (ভিন্ন ধরনের তন্তু বা ফাইবার দিয়ে তৈরি সুতা, যা মূলত বস্ত্র, কাপড় এবং নানান প্রকারের বোনা পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয় )ইত্যাদি পণ্যের প্রতিষ্ঠান দেখা যায়।
শিল্পায়নে ইপিজেড এর ভূমিকা-
ইপিজেড বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। যেমন ইপিজেডগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মূল কারণ হলো বিনিয়োগকারীদের জন্য এখানে প্রদত্ত কর ছাড়, সহজ শুল্ক নীতি এবং রপ্তানির বিশেষ সুবিধা। বিদেশি বিনিয়োগের ফলে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে এবং শিল্প খাতের বিকাশ ঘটেছে। এক্ষেত্রে মূলত চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে ইপিজেড গুলোতে ৪৫০ টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, যেগুলো সরাসরি রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদন করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এভাবে এটি দেশের রপ্তানি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
ইপিজেড থেকে উৎপাদিত পণ্য সরাসরি রপ্তানি হয়, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ২০ শতাংশেরও বেশি। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে ইপিজেডগুলোর অবদান উল্লেখযোগ্য। এ অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্যসমূহের মধ্যে পোশাক, ইলেকট্রনিক পণ্য, ফুটওয়্যার, চামড়াজাত পণ্য এবং প্লাস্টিক সামগ্রী বৈশ্বিক বাজারে প্রচুর চাহিদা তৈরি করেছে। ইপিজেড গুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার রপ্তানি বাজারকে বৈচিত্র্যময় করতে সক্ষম হয়েছে এবং শিল্প খাতে একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছে।
ইপিজেড শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে ইপিজেড গুলোতে প্রায় ৫ লাখেরও বেশি মানুষ কাজ করছে, যার মধ্যে অধিকাংশই নারী। ইপিজেড-এ কর্মরত শ্রমিকরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ পেয়ে বিভিন্ন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দক্ষ হয়ে ওঠে। এই দক্ষ শ্রমশক্তি ভবিষ্যতে দেশের শিল্পোন্নয়নের জন্য মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে।
ইপিজেড এর মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও উৎপাদন কৌশল দেশে প্রবেশ করেছে। বিদেশি কোম্পানিগুলো স্থানীয় কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অত্যাধুনিক মেশিন ও প্রযুক্তির ব্যবহার শিখাচ্ছে। এর ফলে দেশীয় শিল্পেও আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব পড়ছে, যা সামগ্রিকভাবে দেশের শিল্প খাতকে আরো প্রতিযোগিতামূলক করছে।
এছাড়াও, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও দক্ষতাবৃদ্ধির মাধ্যমে ইপিজেড কর্মীরা অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রেও অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। এছাড়া এটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নত অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সরবরাহ, সড়ক যোগাযোগ এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটেছে। এর ফলে শুধু ইপিজেডের ভেতরেই নয়, এর আশেপাশের এলাকাগুলোতেও উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। স্থানীয় জনগণ এই উন্নত অবকাঠামো সুবিধা ভোগ করছে এবং তাদের জীবনমানও উন্নত হচ্ছে।
ইপিজেড গুলোতে শিল্পায়নের ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ইপিজেড থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে, যা দেশের আমদানি-রপ্তানি ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করছে। এছাড়াও, ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাতও এর মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে।
কারণ বিনিয়োগকারীরা স্থানীয় ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করেন এবং তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থানীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। ইপিজেড-এর আরেকটি লক্ষ্য হলো শিল্পায়নের বিকেন্দ্রীকরণ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইপিজেড স্থাপন করা হয়েছে, যা শুধু রাজধানী বা বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভরশীল না থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্প বিকাশে সহায়তা করছে। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতি উন্নয়নের সুযোগ হয়েছে এবং আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস পেয়েছে। এর মাধ্যমে একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশও তৈরি হয়েছে যেখানে বিনিয়োগকারীরা কম ঝুঁকিতে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন। সহজ শুল্কনীতি, কর সুবিধা এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমানোর মাধ্যমে ব্যবসা পরিবেশকে উন্নত করার চেষ্টা করার ফলে দেশীয় এবং বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীদের জন্য শিল্প স্থাপন এবং পরিচালনা সহজতর হয়েছে ।
বর্তমান চ্যালেঞ্জসমূহ-
ইপিজেড শিল্পায়নের চ্যালেঞ্জের কথা বললে প্রথমেই বলা যায় যে, পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কারখানার বর্জ্য এবং ধোঁয়া নির্গমন পরিবেশের ক্ষতি করছে। যদিও সরকার পরিবেশ সুরক্ষার জন্য কঠোর নিয়মাবলি প্রণয়ন করেছে, তবুও এই সমস্যার সমাধান এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। তাছাড়া ইপিজেডের অনেক কারখানায় শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। শ্রমিকদের জন্য যথাযথ কর্মপরিবেশ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবসময় সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য এবং হয়রানির অভিযোগ উঠছে। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের অধিকার এবং সুরক্ষার জন্য আরো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের ইপিজেডগুলোর আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা। চীন, ভিয়েতনাম, ভারতসহ অন্যান্য দেশেও ইপিজেড ব্যবস্থা চালু রয়েছে, যা বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি করছে। ইপিজেডের উৎপাদনশীলতা এবং পণ্যের মান বৃদ্ধির জন্য তাই দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
পরিশেষে বলা যায়,বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নে ইপিজেড একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করছে। এর মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর সম্ভব হয়েছে। যদিও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে সঠিক নীতিমালা এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইপিজেডের সুবিধা আরো বাড়ানো সম্ভব। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইপিজেড বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে দেশের শিল্পায়ন আরো দ্রুততর হবে বলে আশা করা যায়।