নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে যেনো একটি নতুন সূর্যোদয় ঘটেছে। তারুণ্যের নিরলস আন্দোলন, চেতনা ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে একটি বৈষম্যবিহীন দেশের স্বপ্ন, যা আজ বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর। তবে এ বিজয় সহজ ছিল না। নতুন প্রজন্মের আপসহীন সংকল্প, সমতার জন্য আপ্রাণ সংগ্রাম এবং আত্ম ত্যাগই এই পরিবর্তনের পথে আলোর দিশা দেখিয়েছে। তরুণদের এই আন্দোলন ছিল কেবল রাজনৈতিক নয়; এটি ছিল একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, সুশাসন ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এখন এক নতুন পরিবর্তনের যুগে প্রবেশ করেছে। যেখানে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা উন্নয়নের এক নতুন সম্ভাবনা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। একদিকে প্রবৃদ্ধির ধারা, অন্যদিকে নতুন চ্যালেঞ্জ- এই দুইয়ের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতি এগোচ্ছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ভূমিকা ও গুরুত্ব: বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ এক বিশাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যেখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) খাত দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে চলেছে। এসএমই খাত শুধু অর্থনীতির ভিত্তিই নয়, এটি প্রায় দুই কোটির বেশি মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করছে। যা দেশের দারিদ্র্য বিমোচন এবং আয় বৃদ্ধির একটি বড় মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের শিল্পখাতের কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশই এসএমই খাত থেকে আসে, যা বুঝিয়ে দেয় দেশের আর্থসামাজিক বিকাশে এই খাতের ভূমিকা কতটা অপরিহার্য। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে এই খাতের অবদান স্পষ্ট। কুটির শিল্পের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যেমন হাতে তৈরি পণ্য উৎপাদনে অবদান রাখছেন, তেমনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় নিজেদের শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছে।
সারাবিশ্বে ছোট ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোগই ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল শক্তি। জাতিসংঘের তথ্য (২৭ জুন ২০২৪) হিসাবে বিশ্বের ব্যবসার ৯০ শতাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের। মোট কর্মসংস্থানের ৭০ শতাংশই এ খাতের। বিশ্ব জিডিপিতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অবদান অর্ধেক। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভীত শক্তিশালী করতে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোগ (সিএমএসএমই) এবং এই খাতের অবদান অসামান্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক শুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৭৯ লাখ সিএমএসএমই প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যা দেশের শিল্প ও বাণিজ্য খাতের এক বিশাল অংশ দখল করে রেখেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি থেকে শুরু করে আর্থিক স্থিতিশীলতা পর্যন্ত এই খাতের বহুমুখী প্রভাব আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোকে সুসংহত করছে।
কুটির শিল্প থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোই দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে। এই উদ্যোগগুলো স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে শুধু উৎপাদন বাড়াচ্ছে না, বরং রপ্তানি খাতেও নতুন মাত্রা যোগ করছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নিরলস পরিশ্রম ও সৃজনশীলতার কারণে বাংলাদেশে তৈরি পণ্য আজ বৈশ্বিক বাজারেও স্থান করে নিচ্ছে, যা রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোগ (সিএমএসএমই) এবং এই খাতের অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ, যা এ খাতের বিশাল সম্ভাবনারই প্রমাণ। যদি এই খাত আরও সহযোগিতা ও সুযোগ পায়, তবে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এর ভূমিকা হতে পারে অনন্য।
হস্তশিল্প, পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত সামগ্রী, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সিরামিক এবং হালকা প্রকৌশল- এসব খাতে সিএমএসএমইর সম্ভাবনা অপরিসীম। সিএমএসএমই খাতের বিকাশ ত্বরান্বিত হলে একদিকে যেমন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, তেমনি বাড়বে দেশের রাজস্ব আয় ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে এই খাতের আরও সম্প্রসারণ প্রয়োজন, যা আমাদের অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত হিসেবে কাজ করবে।
বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা: তবে বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট ও মুদ্রাস্ফীতির ফলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা এবং বাজারে প্রবেশে জটিলতা- এসব বাধা অতিক্রম করে উদ্যোক্তারা সামনের দিকে এগোচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে সরকারের সঠিক নীতি, আর্থিক সহায়তা এবং উদ্ভাবনী সমাধান গ্রহণের মাধ্যমে এই বাধাগুলো কমিয়ে আনা সম্ভব। সামষ্টিক অর্থনীতির প্রসারে এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও বৃহৎ ভূমিকা পালন করতে পারবেন।
সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা: ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের টেকসই উন্নয়নের জন্য সহায়তা জরুরি। সহজলভ্য অর্থায়ন, ট্যাক্স ছাড়, প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা- এসব পদক্ষেপ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (এসএমই) বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ- সরকার যদি সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা এবং ট্যাক্স ছাড়ের সুযোগ দেয়, তবে উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসাকে বিস্তৃত করতে পারবেন। ফলে তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান এবং দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্ভাবনী সমাধান ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রতিযোগিতার সাথে তাল মিলিয়ে যদি উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ও দক্ষতায় প্রশিক্ষিত করা যায়, তবে তাঁরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা অর্জন করতে পারবেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তায় বিনিয়োগ ভবিষ্যতের জন্য সোনালী সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করবে এবং টেকসই উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নেবে।
সামষ্টিক অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্যতা: বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হলে তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধি, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানো অপরিহার্য। নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে বড় শিল্পখাতের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে পারলে তাঁদের জন্য নতুন সুযোগের দ্বার খুলে যাবে। উন্নতমানের পণ্য উৎপাদন এবং বাজার গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিলে আমাদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হবেন। এর ফলে শুধু উদ্যোক্তারাই লাভবান হবেন না; বরং দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিও লাভ করবে। বিশ্ববাজারে প্রবেশের এই সুযোগ দেশের অর্থনীতির জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধিকে আরও সুসংহত করবে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, সঠিক দিকনির্দেশনা ও কার্যকর সহযোগিতা পেলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতিতে অবিস্মরণীয় অবদান রাখতে সক্ষম হবেন। এর ফলে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে আরও দ্রুত, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বিস্তৃত পরিসরে এবং দারিদ্র্য কমে আসবে ধীরে ধীরে। তবে এই বিশাল সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে তাঁদের জন্য পুঁজি, প্রযুক্তি এবং দক্ষতা উন্নয়নে কার্যকর সহযোগিতা প্রয়োজন। দেশের উন্নয়নের পথে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের এই অবদান কতটা মূল্যবান, তা উপলব্ধি করে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সকলের দায়িত্ব। সামষ্টিক অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সম্ভাবনাময় অগ্রযাত্রা আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে এসেছে।