সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বহু প্রতীক্ষিত ছাত্র- জনতার বৈষম্যবিরোধী গণ-আন্দোলন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। এর ফলে আমরা একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন এবং নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের অভ্যুদয় দেখেছি। যে কোনো গণ-আন্দোলনের পর জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায় এবং সেই প্রত্যাশা পূরণে নতুন সরকারকে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। যা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করা তাঁদের জন্য অপরিহার্য।
তেমনি ঋণের খেলাপ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই পরিস্থিতি দেশের ব্যাংকিং খাত ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিবেশকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশেষ করে যখন দেশের উন্নয়ন, বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান অনেকটাই ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভরশীল; তখন ঋণ খেলাপির প্রভাব আরো গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে ব্যাংক খাত শক্তিশালী না হলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি থমকে যাবে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় আসার পর থেকে ব্যাংক খাতে ধারাবাহিকভাবে নানা সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী- ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে এই ঋণ বেড়েছে ৫৫ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। যা বৃদ্ধির হার ৩৫ শতাংশ। এই সংকট কেবলমাত্র একটি সংখ্যা নয়; এটি দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য একটি বিপজ্জনক সংকেত। অর্থনীতিবিদদের মতে, খেলাপি ঋণ থাকা মানে ব্যাংক সেই বিনিয়োগ থেকে কোনো লাভ অর্জন করতে পারে না, যা ব্যাংকের মুনাফাকে সরাসরি কমিয়ে দেয়। যখন ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাকে না, তখন তারল্য সংকট দেখা দেয়। এর ফলে ব্যাংকের নতুন ঋণ প্রদান ক্ষমতা হ্রাস পায়, যা বিনিয়োগ কমিয়ে দেয় এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সঙ্কুচিত করে।
বর্তমানে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১২ শতাংশ বলে দাবি করা হলেও, সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত সরকারের অর্থনৈতিক তথ্যের গরমিলের খবরের পরিপ্রেক্ষিতে এই হার আরও বেশি হতে পারে। ঋণ খেলাপির ফলে ব্যাংকিং সেক্টরে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। যখন গ্রাহকরা ব্যাংকগুলোর ওপর থেকে তাদের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, তখন তারা আমানত রাখতে অনীহা দেখান। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোর জন্য একটি ধসের সূচনা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে এই ঘটনারই প্রতিফলন ঘটেছে। ঋণ প্রদানে অক্ষম ব্যাংকগুলোর কারণে ব্যবসায়ীরা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের সাহস হারাচ্ছেন। এর ফলস্বরূপ, বিনিয়োগ কমে গিয়ে বাজারে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ঋণ খেলাপির কারণে শুধু ব্যাংক খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, বরং সরকারের রাজস্ব আয়ও ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। কারণ ব্যাংকগুলো যখন খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয়, তখন সরকার কর আদায়ের একটি বড় উৎস হারায়। এর ফলে সামাজিক ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয় না, যা জনগণের জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম পিছিয়ে পড়ে। আবার অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের নতুন প্রকল্প শুরু এবং দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ঋণের ওপর নির্ভরশীল। খেলাপি ঋণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়ে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে কর্মসংস্থান হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, স্থানীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমনকি বেকারত্বের হারও বেড়ে গিয়েছে। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য তাই ঋণের সংকট আরো বড় সমস্যা সৃষ্টি করেছে। যা তাদের উদ্যোগ শুরু করার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকেও থামিয়ে দিচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই সরকারের সঠিক নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত জরুরি। ঋণ খেলাপির সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে, তা আরো জটিল হয়ে উঠবে। তাই ব্যাংকিং খাতে দ্রুত সংস্কার, ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কার্যকরী কৌশল তৈরি করা দরকার। পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে দায়িত্বশীল ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়াতে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন । যাতে ভবিষ্যতে এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।