ক্রিপ্টোকারেন্সি অর্থাৎ ডিজিটাল বা ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা হলো ডিজিটাল যুগের সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মুদ্রা। যা নিরাপত্তার জন্য ক্রিপ্টোগ্রাফি বা সাংকেতিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এটি কোনো সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। বরং স্বতন্ত্রভাবে ব্লকচেইন নামক আধুনিক প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে চলে। বিটকয়েন ছিল প্রথম এবং সবচেয়ে পরিচিত ক্রিপ্টোকারেন্সি। কিন্তু এর পাশাপাশি ইথেরিয়াম, লাইটকয়েনসহ আরো অনেক ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সিও বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
তবে, ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে যখন উন্নত দেশগুলো বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, বাংলাদেশ এখনও অপেক্ষাকৃত অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সির উত্থান এবং বৈশ্বিক প্রভাব: ২০০৯ সালে যখন প্রথম বিটকয়েন চালু হয়, তখন কেউই ভাবেনি যে এটি একদিন এত বড় আকারে প্রভাব বিস্তার তথ্য করবে। এই মুদ্রার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এটি একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যা এটিকে নিয়ন্ত্রিত মুদ্রার চেয়ে স্বাধীন ও অপেক্ষাকৃত কমঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে । ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে দ্রুত লেনদেন, কম ট্রান্সফার ফি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুবিধা পেতে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি।
বিশ্বব্যাপী বহু দেশ ক্রিপ্টোকারেন্সির সম্ভাবনাকে স্বীকার করে এর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশ ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনকে বৈধতা দিয়েছে এবং নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো তৈরি করেছে। এমনকি কিছু দেশ ক্রিপ্টোকারেন্সিকে সরকারি মুদ্রার মতো ব্যবহার করছে। যেমন – এল সালভাদর। অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রভাব যেমন উন্নত তেমনি কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। যেমন – মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সমস্যা, অর্থপাচার এবং সাইবার হ্যাকিংয়ের আশঙ্কা।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান: বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির অবস্থা এখনও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক নাগরিকদের ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেন করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশনা প্রদান করেছেন । এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়- ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অর্থপাচার, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন এবং এর অপরিবর্তনীয় মূল্য ওঠানামার সম্ভাবনা। বর্তমান আইনি কাঠামোতে ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ । কেউ এ ধরনের লেনদেনে যুক্ত হলে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হতে পারে। বিশ্বজুড়ে ১৫১টি দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি এখন ডিজিটাল মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫ তম।
তবে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও, অনলাইনে কিছু মানুষ ব্যক্তিগতভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন করছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এবং প্রযুক্তিবিদরা এই ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিভিন্ন গোপন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিটকয়েন, ইথেরিয়াম এবং অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন হচ্ছে। ফলে এ খাতে সরকারের নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে অর্থনীতির বাইরে একটি কালো বাজার তৈরি হচ্ছে। এটি দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ এতে সরকারের কোনো আয় আসছে না এবং এটি অর্থপাচার বা সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রেও ঝুঁকিপূর্ণ।
ক্রিপ্টোকারেন্সির সম্ভাবনা: ক্রিপ্টোকারেন্সি একদিকে যেমন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে, তেমনি এটি অনেক সুযোগও তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশে যেখানে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত, সেখানে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার এই প্রক্রিয়াকে আরো সহজ ও দ্রুত করতে পারে। বর্তমানে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে ব্যাংক এবং মানি ট্রান্সফার কোম্পানিগুলো বড় ফি কাটে। যা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
এছাড়াও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সির আগ্রহ বাড়ছে। বিশেষ করে যারা ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিংয়ের কাজ করেন, তারা অনেক সময় আন্তর্জাতিক লেনদেনে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারের কথা ভাবছেন। বিশ্বের অনেক প্রযুক্তি ভিত্তিক কোম্পানি এখন ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অর্থ প্রদান করছে। যা বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের কাছে এক নতুন সুযোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে, এর জন্য সরকারের একটি সুদৃঢ় নীতিমালার প্রয়োজন। যাতে ফ্রিল্যান্সাররা বৈধভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করতে পারে এবং একইসঙ্গে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
নীতিমালা ও আইনগত চ্যালেঞ্জ: বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা আইনি কাঠামোর অভাব। যদিও অনেক দেশ ক্রিপ্টোকারেন্সির নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো তৈরি করেছে, বাংলাদেশে এখনো এ বিষয়ে খুব বেশি আলোচনা বা পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেখানে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ঘটছে, সেখানে ক্রিপ্টোকারেন্সির বৈধতা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। সরকার যদি একটি সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে তবে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স এবং প্রযুক্তি খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে।
তবে, নীতিমালা তৈরি করতে হলে কিছু ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে। অর্থপাচার, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন এবং কর ফাঁকি দেওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এছাড়াও ক্রিপ্টোকারেন্সির দামের ওঠানামা এবং এর মূল্যমানের অনিশ্চয়তা সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: বাংলাদেশের জন্য ক্রিপ্টোকারেন্সি একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হতে পারে, যদি এটি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দেশের তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে এবং এই খাতে নতুন উদ্ভাবনী প্রকল্প গড়ে উঠছে। ফলে ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে একটি ইতিবাচক নীতিমালা তৈরি করে সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে।
তাছাড়া একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হলো ফিনটেক খাত। ফিনটেক কোম্পানিগুলো ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে নতুন ধরনের সেবা প্রদান করতে পারে। বিশেষ করে অনলাইন পেমেন্ট এবং রেমিট্যান্সে এর ব্যবহার অনেক সহজ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি একটি স্বচ্ছ ও সহজবোধ্য নীতিমালা প্রণয়ন করে, তবে ফিনটেক খাতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যেতে পারবে।
বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টোকারেন্সির উত্থান এবং এর সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ বিবেচনায় বাংলাদেশকে পিছিয়ে থাকা উচিত নয়। যদিও বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং ঝুঁকির বিষয় রয়েছে। একটি সঠিক নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে ক্রিপ্টোকারেন্সি বাংলাদেশে বৈধভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। তরুণ প্রজন্ম, প্রযুক্তি খাত এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের উচিত এই খাতটি নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা শুরু করা এবং এর সম্ভাব্য সুবিধা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো। ক্রিপ্টোকারেন্সির সঠিক ব্যবহার দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে, যদি এর ব্যবহারের ওপর উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায়।