নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং তার ব্যবহার শিল্প ও অর্থনীতিতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বর্তমান বিশ্বে যেখানে একটি দেশের সঙ্গে আরেকটি দেশের প্রতিযোগিতা ক্রমাগত বাড়ছে, সেখানে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তির দিকে নজর দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য যেকোনো পণ্য উৎপাদনের খরচ কমানোর ক্ষেত্রে নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরো কার্যকর, দ্রুত এবং সাশ্রয়ী করে তুলতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ- স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং ডেটা অ্যানালাইটিক্সের মতো নতুন প্রযুক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং ব্যবস্থাপনাকে স্বচ্ছ ও দক্ষ করে তোলে।
এ ছাড়াও উৎপাদন খাতে শ্রমের ব্যয় কমানোর পাশাপাশি কাঁচামালের অপচয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হচ্ছে। ফলে কোম্পানিগুলো এখন তাদের পণ্য আরো সাশ্রয়ী মূল্যে গ্রাহকদের হাতে পৌঁছে দিতে সক্ষম হচ্ছে। যা বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে সহায়তা করছে। তবে প্রযুক্তির ব্যবহার কেবল ব্যয় কমাতেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি নতুন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও সুযোগ সৃষ্টি করেছে। যা বাজারের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে উৎপাদনকে গতিশীল করতে পারে।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় খরচ কমানো: অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার শিল্পখাতে একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। যেখানে একসময় স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই শ্রমিকদের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করা হতো, সেখানে এখন আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে কম সময়ে এবং কম খরচে পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে অটোমেশনের ব্যবহার ব্যাপক। উন্নত রোবোটিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশের মাধ্যমে কম খরচে উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে, যা শ্রম খরচে বিপ্লব এনেছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI- Artificial Intelligence) বর্তমানে উৎপাদন খরচ কমানোর ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখছে। উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে এআই এর ব্যবহার করে খরচ কমানো এবং দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে। বিশেষ করে উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য উপকরণ সংগ্রহ এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে এআই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারে। ফলে মানুষের দরকার হয় না, যা অপচয় কমায়। এছাড়া এআই এর মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের মান উন্নত করা এবং ত্রুটির হার কমানো সম্ভব হচ্ছে। ফলে উৎপাদনের খরচও হ্রাস পাচ্ছে।
ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT – Internet of Things) প্রযুক্তি বর্তমানে উৎপাদন খরচ কমানোর ক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। আইওটি-এর মাধ্যমে একটি কারখানার বিভিন্ন যন্ত্র একে অপরের সাথে সংযুক্ত থেকে তথ্য বিনিময় করতে পারে। এর ফলে যন্ত্রপাতির কার্যকারিতা তত্ত্বাবধান এবং রক্ষণাবেক্ষণ খুব সহজে সম্পন্ন করা যায়। উৎপাদন প্রক্রিয়ার নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখতে এ পদ্ধতি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ফলে অপ্রত্যাশিত যন্ত্রপাতি নষ্টের কারণে যে খরচ বেড়ে যায়, তা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।
এছাড়া থ্রিডি প্রিন্টিং (3D Printing) একটি আধুনিক প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে ডিজিটাল মডেল থেকে ত্রিমাত্রিক (3D) বস্তু তৈরি করা হয়। সাধারণ প্রিন্টারের মতো যেখানে ২-মাত্রিক (2D) ফ্ল্যাট কাগজে মুদ্রণ হয়, থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি তাতে একটি অতিরিক্ত তল বা মাত্রা তৈরি করে। যা বস্তুটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতা তৈরি করে। এটি মূলতঃ বস্তুটিকে ধাপে ধাপে (স্তরে স্তরে) গঠন করে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে কোনো জটিল নকশা দ্রুত এবং তুলনামূলক কম খরচে তৈরি করা যায়। থ্রিডি প্রিন্টিং-এর মাধ্যমে উপকরণের অপচয়ও কম হয়, ফলে উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। থ্রিডি প্রিন্টিং শিল্প-কারখানা ছাড়াও নির্মাণ ও স্বাস্থ্যসেবার মতো ক্ষেত্রগুলোতেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে উৎপাদন খাতে বেশ কিছু আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে, তবে সব খাতে একইভাবে প্রযুক্তির প্রসার ঘটেনি। চলমান পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাক শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার তুলনামূলকভাবে বেশি। এখানে স্বয়ংক্রিয় কাটিং ও সেলাই মেশিন, ডিজিটাল নকশা সফটওয়্যার এবং বারকোডিং প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। যা উৎপাদন প্রক্রিয়াকে দ্রুত ও ত্রুটিমুক্ত করছে। চামড়া ও ওষুধ শিল্পেও লেজার কাটিং, স্বয়ংক্রিয় প্যাকেজিং এবং গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএন্ডডি – Research and Development) প্রযুক্তির প্রসার দেখা যাচ্ছে, যা পণ্যের মান উন্নয়নে সহায়ক।
তবে অন্যান্য কিছু খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার এখনও অনেকটাই সীমাবদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ- কৃষি এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার ততটা প্রচলিত নয়। এই খাতগুলোতে অধিকাংশ কাজ ম্যানুয়ালি বা প্রাথমিক স্তরের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে করা হয়। যার ফলে উৎপাদনশীলতা ও মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া এসএমই খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যয়বহুল মেশিন কেনা এবং উচ্চ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মী রাখা সম্ভব হয় না।
প্রযুক্তির এই ব্যবহারে বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে প্রশিক্ষিত জনশক্তির অভাব, প্রযুক্তির উচ্চমূল্য এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তার অভাব। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা এগিয়ে থাকলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিজিটালাইজেশন বা আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
অন্যদিকে স্বয়ংক্রিয় রোবোটিক প্রযুক্তি এবং আইওটি প্রযুক্তির ব্যবহার এখনও বাংলাদেশে প্রচলিত হয়নি, যা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দেশের খাতভেদে প্রযুক্তির ব্যবহারের এই বৈষম্য পূরণ করতে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতা বাড়ানো প্রয়োজন। যাতে উৎপাদন খাতে সকল স্তরে আধুনিকায়ন সম্ভব হয়।
প্রযুক্তিগত কৌশলগুলো কীভাবে খরচ কমায়?
প্রথমতঃ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া আরও গতিশীল ও কার্যকরী হয়। এর ফলে কাজের সময় এবং খরচ কমে আসে।
দ্বিতীয়তঃ ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে কাঁচামাল এবং উপকরণের ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হয়, ফলে অপচয় কমে।
তৃতীয়তঃ গবেষণা ও উন্নয়নে প্রযুক্তির সাহায্যে নতুন পণ্য তৈরি করা সহজ হয়, যা উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করে। রোবট ব্যবহার করে অনেক ম্যানুয়াল কাজের প্রয়োজন কমে যায়, যা খরচ সাশ্রয়ে সাহায্য করে। এভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার উৎপাদন খাতে কার্যকারিতা এবং লাভ বৃদ্ধি করে।
অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে উৎপাদন খাতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। তাই অবশ্যই এক্ষেত্রে উন্নতি করতে আমাদের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কেননা, পৃথিবীর বহু দেশ আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন ব্যয় কমানোর সুফল ভবিষ্যতের জন্য অনেক সম্ভাবনা নিয়ে আসবে। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ।
বাংলাদেশে যদি প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার বাড়ানো যায়, তাহলে শিল্পের উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। উৎপাদন ব্যয় কমানোর এই কৌশলগুলো শুধু অর্থনৈতিক লাভই নয়, বরং পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই ভবিষ্যতের দিকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। এক কথায়, প্রযুক্তির সাহায্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের এই যাত্রায় বাংলাদেশ এক সম্ভাবনাময় সাফল্যের গল্প রচনা করতে প্রস্তুত হতে হবে।