বাংলাদেশ ব্যাংক বা আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা (বিএফআইইউ) বরাত দিয়ে কয়েক দিন থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ১০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে রিসিভার নিয়োগ বিষয়ে প্রতিবেদন দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে বিএফআইইউ ও বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি তারা। বিএফআইইউ জানায়, কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে রিসিভার নিয়োগ দিতে পারে না। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে রিসিভার নিয়োগ দিতে হয়, তাহলে পার করতে হয় দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া।
বিএফআইইউর প্রধান এ কে এম এহসান বলেন, ‘একটি ব্যবসায়ী গ্রুপে রিসিভার নিয়োগ দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু তারা রিট করার কারণে প্রক্রিয়াটি এখন স্থগিত আছে। ওই কোম্পানির আরো কিছু প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তবে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে রিসিভার নিয়োগের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। রিসিভার নিয়োগ দেওয়ার আগে অন্তত পাঁচটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো এখতিয়ারই নেই বিএফআইইউর। যদি কখনো আদালত রিসিভার নিয়োগের নির্দেশ দেন, তখন সেটা নিয়ে আমরা কাজ করব। কিন্তু এর আগে কিছু করার সুযোগ নেই।’
প্রথমত, অর্থপাচারে জড়িত সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করা; দ্বিতীয়ত, সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট তলব বা জব্দ করা; তৃতীয়ত, লেনদেনের পদচিহ্ন অনুসরণ করে অর্থপাচার শনাক্ত করে দুদক বা সিআইডিকে পাঠানো; চতুর্থত, দুদক বা সিআইডির মাধ্যমে আদালতে অর্থপাচারের মামলা, সব শেষে আদালতের নির্দেশে দেশীয় সম্পদ ক্রোক করার জন্য রিসিভার নিয়োগ এবং বিদেশ থেকে অর্থ ফেরাতে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা। এই প্রক্রিয়ায় অর্থ আদায় করতে হয়। এখন পর্যন্ত এস আলম ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদ ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের অর্থপাচার শনাক্তের কাজই শেষ হয়নি। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা জানিয়েছেন, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদের পাচার করা সম্পদ দেশে ফেরাতে আইনজীবী নিয়োগ করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজ ইচ্ছায় কোনো কম্পানির জন্য রিসিভার বা প্রশাসক নিয়োগ করবে না। তবে হাইকোর্ট নির্দেশ দিলে অবশ্যই নিয়োগ দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা আরও বলেন, ‘রিসিভার নিয়োগ করতে হলে আদালতের নির্দেশ প্রয়োজন হয়। এখন পর্যন্ত একটি শিল্প গ্রুপে রিসিভার নিয়োগের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এসেছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেশের অন্য কোনো শিল্প গ্রুপে কিংবা প্রতিষ্ঠানে রিসিভার নিয়োগ করবে না।’
বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ভুল তথ্য পরিবেশন করে বিগত সরকারের সময় ভুল নীতি তৈরি করা হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে আমাদের রপ্তানি খাতে ভুল বা মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে অন্যায় করা হয়েছে। সবার প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধে সাংবাদিকতার সব নীতিমালা মেনে চলতে হবে।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘দেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে যাঁরা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন, তাঁরাই নিগৃহীত ছিলেন। বেকারদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে দরকার বিনিয়োগ, কিন্তু দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। বিনিয়োগকারীরা এখন চতুর্মুখী বিপদের সম্মুখীন।’
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘ব্যাংকঋণের ৯ শতাংশ সুদ বেড়ে এখন ১৪-১৫ শতাংশ হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এত সুদ দিয়ে ব্যবসা টেকসই করা কষ্টসাধ্য। তারপর ঋণখেলাপির বিধি পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন কিস্তি না দিলে ৯০ দিন পর খেলাপি ঘোষণা করা হবে। এতে আমরা শঙ্কিত। সুদহার বৃদ্ধির পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি সরবরাহ করা হচ্ছে না।’
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা-উদ্যোগে পরিচালন ব্যয় বেড়েছে ৩০ শতাংশ। ব্যাংকঋণের সুদহার দফায় দফায় বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। প্রায় আড়াই বছর ধরে অব্যাহত সংকটের কারণে ডলারের দরও বেড়েছে প্রায় ৪১ শতাংশ। এতে আমদানি কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর ফলে শিল্পে উৎপাদন সংকুচিত হয়েছে। পরিবহন খরচ বেড়েছে। এসবের প্রভাবে ব্যয়বহুল হয়েছে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বিভিন্ন রেগুলেটরি সংস্থার ভুল নীতি এবং সময়-অসময়ে দেওয়া বিভিন্ন সার্কুলার অনেক উদ্যোক্তাকে ঋণখেলাপিতে পরিণত করেছে। তাই স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপি নয়, বরং সরকারের নীতিমালার জন্য খেলাপি হয়েছেন এমন উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখার দাবি উঠেছে। অন্যথায় সামনে দেশের কর্মসংস্থানসহ অর্থনীতিতে স্থবিরতা দীর্ঘায়িত হবে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এস আলম, বেক্সিমকোসহ বড় বেশ কিছু শিল্প গ্রুপের মালিকদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে বিএফআইইউ। পাশাপাশি তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে, এমন কোনো বেআইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না, যা কোনো ব্যক্তির জীবন, সুনাম ও সম্পত্তির ক্ষতির কারণ হয়। এ ছাড়া দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত একজন ব্যক্তিকে অপরাধী বলা যাবে না। দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, বিনিয়োগকারী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হওয়া মিডিয়া ট্রায়ালে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত তুলে নিচ্ছে। শুধু ব্যাংক নয়, মিডিয়া ট্রায়ালের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন খাতেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে।