সয়াবিন ও পাম তেল বর্তমানে খাদ্য প্রসাধনী শিল্প, রন্ধনশিল্প, জ্বালানি ও শিল্পক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত। বাংলাদেশে খাদ্য এবং শিল্প খাতে সয়াবিন ও পাম তেল অপরিহার্য হলেও এর ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে আমাদের পরিবেশ এবং অর্থনীতির ওপর বড় প্রভাব পড়েছে। খাবার রান্না থেকে প্রসাধনী পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত এই তেল শুধু মানুষের জীবনযাত্রার অংশ নয় বরং এর সাথে জড়িত রয়েছে প্রকৃতি ও অর্থনীতির ভারসাম্যও। আন্তর্জাতিক বাজারে এই তেল গুলোর চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে এবং বাংলাদেশও এদের জন্য আমদানির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার ফলে দেশের বাজারেও মূল্যবৃদ্ধির চাপ পড়েছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছে। ফলে একদিকে যেমন তেলের দাম বৃদ্ধির ঝুঁকি রয়েছে, অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে তেল উৎপাদনের সুযোগও আছে। যা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির জন্যও সহায়ক হতে পারে। এর প্রেক্ষিতে পরিবেশ রক্ষা এবং দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সয়াবিন ও পাম তেলের ব্যবহার এবং উৎপাদনে টেকসই ও বিকল্প সমাধানের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
বৈশ্বিক চাহিদা ও উৎপাদনের চিত্র- বর্তমানে সয়াবিন ও পাম তেলের বৈশ্বিক চাহিদা প্রায় ১৩৫ মিলিয়ন টন, যা আগামী দশকে আরও বাড়তে পারে। প্রধান সয়াবিন উৎপাদক দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা শীর্ষে রয়েছে। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া বিশ্বের প্রায় ৮৫% পাম তেল সরবরাহ করে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমাদের মোট ভোজ্য তেলের ৯০% এর বেশি আমদানির ওপর নির্ভরশীল। যার বড় অংশ সয়াবিন ও পাম তেল।
বাংলাদেশে মোট ভোজ্য তেলের চাহিদা বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন। ২০২৩ সালের হিসেব অনুযায়ী- দেশে সয়াবিন তেলের চাহিদা বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন এবং পাম তেলের চাহিদা প্রায় ১২ লাখ টন। তেল আমদানির এই চাহিদা বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং দেশীয় বাজারে তেলের দামকে প্রভাবিত করে। ফলে বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি হলে বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়ে সরাসরি। যা জনগণের জন্য বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে।
পরিবেশের ওপর প্রভাব- আধুনিক বিশ্বে পাম ও সয়াবিন তেল উৎপাদনের জন্য প্রচুর বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় প্রতিদিন প্রায় ১০০ হেক্টর বনভূমি পাম খামার তৈরির জন্য উজাড় করা হচ্ছে। এর ফলে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং কার্বন সঞ্চয়ের প্রাকৃতিক পদ্ধতিগুলো নষ্ট হচ্ছে। প্রতিবছর শুধুমাত্র বন উজাড়ের কারণে ৭ কোটি টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ হয়, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
সয়াবিন তেল উৎপাদনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সমস্যা দেখা যায়। অ্যামাজনের রেইনফরেস্ট- যা বৈশ্বিক কার্বন সঞ্চয়ের একটি বড় উৎস, সয়াবিন চাষের জন্য ধ্বংস করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে- অ্যামাজনের প্রায় ১৭% বনভূমি ইতোমধ্যে সয়াবিন চাষের জন্য হারিয়ে গেছে, যা গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে ত্বরান্বিত করেছে। এই বন উজাড়ের সাথে সাথে আমাদের বায়ুমণ্ডলে কার্বনের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য হুমকি স্বরূপ।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রভাব- বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার উপর সয়াবিন ও পাম তেল আমদানির চাপ ক্রমেই বাড়ছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে তেল আমদানিতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল, যা বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি বাড়াচ্ছে। তেলের উচ্চ মূল্য সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
আমদানি করা তেলের মূল্যের উপর আমাদের ব্যাপক নির্ভরশীলতা অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের ফলে তেলের দাম ২০% থেকে ৩০% পর্যন্ত বেড়ে যায়। যার ফলে ভোক্তারা অধিক মূল্যে তেল কিনতে বাধ্য হয় এবং তা দেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে না পারলে এভাবে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব আরও বাড়বে, যা অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।
টেকসই সমাধান- বাংলাদেশে স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে হলে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ফসলের উপর জোর দেওয়া দরকার। সূর্যমুখী ও ক্যানোলা তেলের মতো পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী বিকল্প খুঁজে বের করে কৃষকদের উৎসাহিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ুতে এই ফসলগুলো চাষের উপযোগী। কুষ্টিয়া, পাবনা ও বগুড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় ইতোমধ্যে সূর্যমুখীর চাষ শুরু হয়েছে।
এই ধরনের উৎপাদন বাড়ালে আমাদের আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। এছাড়া পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব, যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। আন্তর্জাতিকভাবে কৃষিতে জৈব পদ্ধতির ব্যবহার এবং টেকসই প্রযুক্তির প্রসার আরও টেকসই অর্থনীতির দিকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারে।
সয়াবিন ও পাম তেলের বিশ্বব্যাপী চাহিদা খাদ্য ও শিল্প খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এদের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং আমদানির কারণে পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো এবং বিকল্প উৎসের উপর নির্ভরতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় নিশ্চিত করে আমাদের একটি টেকসই অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য এসব পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।