শক্তি ছাড়া পৃথিবী যেন নিস্তব্ধ। নানা রকম শক্তির রূপান্তরের মাধ্যমে আজকের পৃথিবী ও মানবসভ্যতা টিকে আছে এবং সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিকল্প শক্তি বলতে জীবাশ্ম জ্বালানির বাইরে অন্যান্য শক্তির উৎসকে বোঝানো হয়। কিন্তু আমাদের প্রাকৃতিক জ্বালানি যেমন: তেল, গ্যাস এবং কয়লার মজুদ সীমিত। প্রতিনিয়ত তা নিঃশেষের পথে এগোচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। যা পরিবেশ, জীবন এবং অর্থনীতিকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। এই সংকট থেকে মুক্তির উপায় হলো বিকল্প শক্তির দিকে মনোযোগ দেওয়া। যা পরিবেশবান্ধব এবং স্থায়িত্বশীল। সবুজ ও নিরাপদ পৃথিবীর স্বপ্ন পূরণে টেকসই শক্তির উৎস এখন সময়ের দাবি। যা বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবীর প্রতিশ্রুতি বহন করে।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ। যেখানে শিল্প, কৃষি ও গৃহস্থালির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে শক্তির প্রয়োজন দিন দিন বাড়ছে। তবে আমাদের বেশিরভাগ জ্বালানির উৎস জীবাশ্ম জ্বালানি, যা পরিবেশ দূষণের প্রধান কারণগুলোর একটি। দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদও সীমিত। আর কয়লার ব্যবহারে বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর কার্বন নির্গমন ঘটে। যা তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী- দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশই জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে আসে। যা আমাদের পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উভয়ের জন্যই হুমকি স্বরূপ।
বিশ্বব্যাপী শক্তির টেকসই উৎস হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ ও বায়োমাস- এই শক্তিগুলো কার্বনমুক্ত এবং পরিবেশবান্ধব হওয়ায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে- বিশ্বজুড়ে সৌর এবং বায়ুশক্তির উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে, যা বিকল্প শক্তির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। উদাহরণ স্বরূপ- ২০২০ সাল চীনের ইতিহাসে সৌর শক্তির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম সংযোজনের বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই বছর বায়ু শক্তির সাথে মিলিয়ে চীনের মোট শক্তির প্রায় ১০% এসেছে অ-জলবিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে। চীনের পরিকল্পনা ছিল- ২০২১ সালের শেষে সৌর ও বায়ু শক্তির এই অংশকে ১১% এ উন্নীত করা এবং এটি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এই অগ্রগতি দেশের শক্তির বিভিন্নীকরণ এবং পরিবেশ বান্ধব শক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকার গ্রামাঞ্চলে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। যার ফলে বর্তমানে প্রায় ৫ মিলিয়নের বেশি পরিবার সোলার হোম সিস্টেমের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। এছাড়া দেশের কিছু অংশে বায়ুশক্তির উৎপাদনেও বিনিয়োগ বাড়ছে, যা সামগ্রিকভাবে পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে সোলার শক্তির রূপরেখা অনুযায়ী- ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের প্রায় ৩০% বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা সত্যিই একটি যুগান্তকারী সাহসী পদক্ষেপ।
ফসিল ফুয়েল ব্যবহারে যে বিশাল পরিমাণ কার্বন নির্গত হয়, তা জলবায়ুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিকল্প শক্তি যেমন: সৌরশক্তি এবং বায়ুশক্তির ব্যবহার, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা কমিয়ে বিশ্ব উষ্ণায়ন কমাতে সহায়তা করে। উদাহরণ স্বরূপ- সৌর এবং বায়ুশক্তি ব্যবহারের ফলে সরাসরি কার্বন নির্গমন প্রায় শূন্য হওয়ায় এর পরিবেশগত প্রভাব অনেক কম। এ ছাড়া জলবিদ্যুতের ব্যবহারে পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়, যা পরিবেশের জন্য সহায়ক।
নবায়নযোগ্য শক্তি খাতের প্রসার শুধু পরিবেশের উন্নতি নয় বরং দেশের অর্থনীতির জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে। বিকল্প শক্তি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও অবকাঠামোর সম্প্রসারণে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী প্রয়োজন। ফলে বেকারত্বের হার হ্রাসে এটি একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদনে উৎসাহী বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ তৈরি হচ্ছে। যা দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে এখনও অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব, উচ্চ উৎপাদন খরচ ও যথাযথ অবকাঠামোর অভাব এক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন কার্যকর সৌর ও বায়ুশক্তি ব্যবহার করতে হলে প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং কারিগরি জ্ঞানের প্রসার অপরিহার্য। এই ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় এবং বিনিয়োগে উৎসাহ প্রদান প্রয়োজন। আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিকল্প শক্তির তথ্য সমূহ:-
সৌরশক্তি: সৌর শক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে পৃথিবীর সিংহভাগ বিদ্যুৎ শক্তির চাহিদা মেটানো সম্ভব। তথ্য মতে- ১ বছরে যে পরিমাণ সৌরশক্তি পৃথিবীতে আসে তা দিয়ে সারা পৃথিবীর বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী ৮ হাজার বছর চলবে। পৃথিবীতে প্রতি বর্গমিটারে গড়ে ১ হাজার ৬৫ ওয়াটের সমপরিমাণ সৌরশক্তি আসে। সৌরশক্তি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব এবং নবায়নযোগ্য। বাংলাদেশের সৌর বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে সাফল্য পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ভূ- উত্তাপ শক্তি: মাটির নিচে জমা রয়েছে ভূ-উত্তাপ শক্তি বা জিও থার্মাল শক্তি। দীর্ঘদিনের গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দেড় শতাংশ বৈদ্যুতিক শক্তির অবদান রয়েছে- এই শক্তির। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৮ হাজার মেগাওয়াট ভূ-উত্তাপ শক্তি উৎপাদিত হচ্ছে। এর বড় অংশ প্রায় ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটই আমেরিকাতে উৎপাদিত হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ- আমরা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের কথা বলতে পারি।
পারমানবিক শক্তি: ফ্রেন্চ পদার্থবিদ হেনরি বেকেরেল সর্বপ্রথম ১৮৯৬ সালে পারমাণবিক শক্তি উদ্ভাবন করেন। তিনি অন্ধকারে ইউরেনিয়ামের পাশে রক্ষিত ফটোগ্রাফিক প্লেটের বর্ণ পরিবর্তন দেখে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ হন। পারমানবিক শক্তি উৎপাদনের সাফল্য ঘেটে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র অনেক এগিয়ে আছে । দেশটির মোট বিদ্যুতে পাঁচ ভাগের এক ভাগ আসছে আণবিক শক্তি কেন্দ্র থেকে। তাপ উৎপাদন করে যা বিভিন্ন গবেষণা ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হয়।
বায়ু খামার: বাতাসের চেয়ে শক্তিকে কাজে লাগানোর কথা অনেক আগে থেকেই ভেবে এসেছেন গবেষকরা। “উইন্ড মিল” স্থাপনের পর থেকেই সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয় বায়ু খামার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বায়ু চালিত জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গেল কয়েক বছরে সর্বমোট ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার মাধ্যমে সাফল্যের প্রমাণ মিলেছে সেখানে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালেই দেখা যাবে, তাদের কর্মপরিকল্পনায় ভবিষ্যতের শক্তির উৎস হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার পাঁচ ভাগের এক ভাগ বায়ু শক্তির সাহায্যে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে পূরণ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। পাশাপাশি সফলতা দেখা মিলেছে ডেনমার্কে। তাদের চাহিদার ২০ ভাগ শক্তির যোগান দিচ্ছে উইন্ডমিল গুলো। প্রাকৃতিক উৎস দিয়ে পরিচ্ছন্ন শক্তির ব্যবস্থা করার স্বপ্ন পূরণে “বায়ু খামার” বর্তমান স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যাবে অদূর ভবিষ্যতে।
পরিবেশবান্ধব একটি সবুজ পৃথিবীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিকল্প শক্তির ভূমিকা আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কার্বনমুক্ত এবং টেকসই শক্তির ব্যবহার আমাদের দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থার ওপর সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিকল্প শক্তি খাতের উন্নয়নে পর্যাপ্ত গবেষণা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা গেলে বাংলাদেশ শুধু পরিবেশ রক্ষায় নয় বরং নিজেকে শক্তির ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে পারবে।