বর্তমান যুগে প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। ডিজিটালাইজেশন এখন আর কেবল একটি প্রযুক্তিগত প্রবণতা নয়। এটি আমাদের সমাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভিত্তিগুলোকে নতুনভাবে সাজিয়েছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে যেখানে দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব। সেখানে ডিজিটালাইজেশন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সহজেই জনগণের কাছে তাদের সেবা ও কার্যক্রম পৌঁছে দিচ্ছে। এভাবেই ডিজিটালাইজেশন জনগণের অংশগ্রহণ, সেবা গ্রহণের সহজলভ্যতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
E-Government পোর্টাল হলো একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। যেখানে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের তথ্য, সেবা ও সুবিধাসমূহ অনলাইনে নাগরিকদের জন্য সহজলভ্য করা হয়। এই পোর্টালের মাধ্যমে নাগরিকরা ঘরে বসেই বিভিন্ন সরকারি সেবা, আবেদন, অভিযোগ নিবন্ধন এবং তথ্য প্রাপ্তির সুবিধা পেয়ে থাকে। যা সরকারি সেবার মান ও গতিকে আরও উন্নত করেছে। দেশের নাগরিকদের সময় ও শ্রম বাঁচিয়ে সরকারি সেবাগ্রহণ প্রক্রিয়াকে আরো সহজ ও কার্যকর করে তুলেছে। এর ফলে সরকারি কার্যক্রমে জবাবদিহির স্তর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়েছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ হয়েছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন- ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল হলো একটি বৈশ্বিক সংস্থা। যা বিশ্বজুড়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কাজ করে। এ সংস্থাটি বিভিন্ন দেশের সরকার, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা পর্যবেক্ষণ করে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে তথ্য সরবরাহ করে।
অন্যদিকে, পিপলস অ্যাকাউন্টেবিলিটি মনিটরিং বলতে সাধারণ জনগণের মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রম ও সিদ্ধান্তের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। এটি এমন একটি উদ্যোগ যেখানে জনগণ সক্রিয়ভাবে সরকারি নীতিনির্ধারণ, কার্যক্রম ও সেবার মান পর্যবেক্ষণ করে এবং তার ভিত্তিতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার দাবি তোলে।
ডিজিটালাইজেশনের বিপ্লব বেসরকারি খাতেও অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে। অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল পেমেন্ট ও ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নতুন মাত্রার স্বচ্ছতা এসেছে। এখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই গ্রাহকদের লেনদেনের ইতিহাস ও পরিসংখ্যান তুলে ধরতে পারছে। যা তাদের সেবার মান ও গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে বাড়িয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর উন্নতির ফলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবের মাধ্যমে নাগরিকরা সহজেই সরকারের কার্যক্রম নিয়ে মতামত প্রকাশ করতে পারছে। যা সরকারের প্রতি তাদের দায়িত্বশীলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব প্ল্যাটফর্মে নানা সামাজিক সমস্যার দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে। যা সমাধানের পথে নতুন উদ্যোগ নিতে সহায়তা করছে।
তবে ডিজিটালাইজেশনের সুফলগুলো কিছু সমস্যার ও সম্মুখীন হচ্ছে। যেমন- সাইবার নিরাপত্তা, তথ্যের গোপনীয়তা ও প্রযুক্তিগত বৈষম্য এসব সমস্যার মধ্যে অন্যতম। অনেক সময় দেখা যায়, দক্ষতার অভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারে মানুষ অজ্ঞ বা অসামর্থ্য হয়ে পড়ে। যার ফলে তারা ডিজিটাল সুবিধাগুলি পাচ্ছে না। এ সমস্যাগুলো সমাধানে সরকারের উচিত নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালানো। যাতে নাগরিকরা ডিজিটাল সুবিধাগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে।
তাছাড়া ডিজিটালাইজেশন একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। এতে সরকারের প্রতি জনগণের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির দাবি জোরালো হচ্ছে। তথ্যের প্রবাহ ও ব্যবস্থাপনা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে, যা গণতন্ত্রের শক্তিকে আরও দৃঢ় করছে।
ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার, বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজ একসঙ্গে কাজ করলে; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। ডিজিটাল যুগের এই পরিবর্তনকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি সচেতন হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
সুতরাং ডিজিটালাইজেশন শুধুমাত্র প্রযুক্তির উৎকর্ষ নয়, এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য এক নতুন দিগন্ত। এটি বাংলাদেশের জনগণকে তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে এবং সরকারের প্রতি জবাবদিহি বাড়াতে সক্ষম হয়। ডিজিটালাইজেশন বাংলাদেশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করছে, যা আমাদের আগামী দিনের উন্নয়নের পথপ্রদর্শক হতে পারে।