বর্তমান বিশ্ব নানা সংকটের সম্মুখীন। এর মধ্যে খাদ্য এবং জ্বালানি সংকট সবচেয়ে গুরুতর এবং তীব্রভাবে প্রভাব ফেলছে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও মানুষের জীবনে। দীর্ঘ সময় ধরে চলমান বৈশ্বিক অস্থিরতা, জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি এবং আন্তর্জাতিক সংঘাতের কারণে এসব সংকট আরও জটিল হয়ে উঠেছে। খাদ্য ও জ্বালানির অভাব শুধু দরিদ্র দেশগুলোকেই আঘাত করছে না, বরং উন্নত দেশগুলোও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি, শক্তির দাম বাড়ানো এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন— এ সবই আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরো কঠিন করে তুলছে।
লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা পূরণে সমস্যায় পড়ছে। অন্যদিকে শক্তির দাম বৃদ্ধি, বিশেষ করে তেল ও গ্যাসের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে, আমাদের কাছে প্রশ্ন উঠেছে- এই সংকটগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে এবং ভবিষ্যতে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের প্রভাব কমানো সম্ভব?
খাদ্য সংকট একটি বড় উদ্বেগ:
জাতিসংঘের “বৈশ্বিক জনসংখ্যা সম্ভাবনা ২০২৪” প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৮২০ কোটি। প্রতি বছর জনসংখ্যা বাড়ছে গড়ে ১.১% হারে, যা সংখ্যায় প্রায় ৮৩ মিলিয়ন। জাতিসংঘের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সালে বিশ্বে জনসংখ্যা পৌঁছাবে ৮৫০ কোটিতে।
বিশ্বজুড়ে প্রতি আটজন মানুষের একজন এখনও প্রতিদিন না খেয়ে ঘুমাতে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে এই সংখ্যা আরও বেশি—প্রায় প্রতি চারজনের একজন। দেশের মোট জনগণের ৩৫ শতাংশ এখনো খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
এই খাদ্য সংকট শুধু মানবিক নয়, অর্থনীতির জন্যও বড় ক্ষতির কারণ। অপুষ্টির কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার হারায়। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই সমস্যাটি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়া, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশব্যাপী সংঘাত যেমন: রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ, গমের সরবরাহ ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে দিয়েছে। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনও কৃষি সেক্টরে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। যার ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম এবং সরবরাহের সংকট দ্রুত বেড়ে যায়। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খাদ্যের দাম ২০% বাড়লেও, মার্চে যুদ্ধের প্রভাবে তা ৪০% পর্যন্ত বেড়ে যায়। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসলের ক্ষতি এই সংকটকে আরও তীব্র করে তোলে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্টঅনুযায়ী, ২০২৩ সালেও খাদ্য সরবরাহের এই সংকট একটি বড় বৈশ্বিক ঝুঁকি হিসেবে রয়ে গেছে । এই সংখ্যা প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্য সংকট শুধুমাত্র খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করে না, এটি বিভিন্ন দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও বিপর্যস্ত করছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়, যেখানে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং কৃষির সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের কারণ:
প্রথমেই আমাদের জানতে হবে, কেন এই সংকটগুলো এত গভীরভাবে আমাদের প্রভাবিত করছে। বিশ্লেষকদের মতে-
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। যার ফলে গোটা বিশ্বের খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। ইউক্রেন পৃথিবীর অন্যতম বড় গম ও তেল উৎপাদক দেশ হওয়ায়, যুদ্ধের কারণে তার উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যাহত হয়ে যায়। এর ফলে খাদ্যের মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যা মূলতঃ গরিব দেশগুলোতে সংকট আরও বাড়িয়ে দেয়। একইভাবে, রাশিয়ার গ্যাস এবং তেল সরবরাহে বাধা সৃষ্টি হওয়ার ফলে জ্বালানির দাম বেড়ে যায় এবং শক্তির ঘাটতি সৃষ্টি হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তনও খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের একটি বড় কারণ। পৃথিবীজুড়ে অতিরিক্ত তাপমাত্রা, খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন কেবল কৃষি খাতেই নয়, শক্তি উৎপাদনেও সমস্যা তৈরি করছে। কারণ প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপাদনের জন্য নির্ভরযোগ্য প্রাকৃতিক উৎস কমে যাচ্ছে।
ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত: বিভিন্ন দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হয়েছে, যা খাদ্য ও শক্তির সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিভিন্ন দেশ তাদের রপ্তানি নীতি কঠোর করেছে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে বিশ্বের বাজারে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
জ্বালানি সংকট-অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য হুমকি:
জ্বালানি সংকটও বর্তমানে বৈশ্বিক অস্থিরতার একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের তেল, গ্যাস এবং কয়লা উত্পাদনকারী দেশগুলো তাদের উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ায় শক্তির মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ইউরোপ এবং এশিয়ার বহু দেশ যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, তা অত্যন্ত গভীর। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের সরবরাহ সংকুচিত হয়ে পড়েছে, যা সারা পৃথিবীজুড়ে শক্তির দাম বৃদ্ধি এবং সরবরাহে বাধার সৃষ্টি করেছে।
এই পরিস্থিতিতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জ্বালানির চাহিদা পূরণ করাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে, যার ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশেও জ্বালানি সংকটের প্রভাব পড়েছে। যার কারণে বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়েছে এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সামগ্রিক অর্থনীতি ও জনগণের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
মুদ্রার অবমূল্যায়ন-অর্থনৈতিক অস্থিরতা:
এসময় বিশ্বের নানা দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়নও একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন অর্থনীতিতে নানা ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন বলতে বোঝানো হয় স্বর্ণ, রৌপ্য বা বিদেশি মুদ্রার তুলনায় একটি দেশের মুদ্রার মূল্য কমে যাওয়া। ভাসমান বিনিময় হার ব্যবস্থায়, মুদ্রার মূল্য নির্ধারণ হয় বাজারের চাহিদা ও যোগানের ওপর ভিত্তি করে।
মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে অর্থনীতিতে যেসব প্রভাব পড়তে পারে তা হলো-
প্রথমত মুদ্রার মান কমে গেলে বিদেশি ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য চাপ সৃষ্টি করে। বেসরকারি খাতের জন্য বিনিয়োগ ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে, ফলে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।
অবমূল্যায়নের ফলে রপ্তানি পণ্যের দাম কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ে, যা রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।
একই সঙ্গে আমদানির খরচ বেড়ে যায়, যা সাধারণ মানুষের জন্য পণ্যের দাম বাড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অতিরিক্ত অবমূল্যায়ন অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে । বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন খাদ্য এবং জ্বালানির দাম বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত। এটি স্থানীয় বাজারে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে এবং মানুষের জন্য বেঁচে থাকা আরও কঠিন করে তুলেছে।
সমাধানের পথ:
কীভাবে এ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব?
যেহেতু খাদ্য ও জ্বালানি সংকট বৈশ্বিকভাবে আন্তঃসম্পর্কিত সমস্যা, তাই এর সমাধানও সমন্বিতভাবে গ্রহণ করা জরুরি। এই জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে:
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো: পৃথিবীকে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর যৌথভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে, বিভিন্ন দেশের জন্য শক্তির ব্যবহারকে সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব করতে হবে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগ: জ্বালানি সংকট কাটাতে নবায়নযোগ্য শক্তি যেমন: সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি, জলবিদ্যুৎ এবং বায়োএনার্জির ব্যবহার বাড়াতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহিত করা উচিত। এটি পরিবেশের জন্য উপকারী এবং শক্তির অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত এড়ানো: ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত খাদ্য ও জ্বালানির সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে দেয় এবং বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। বিশ্বের দেশগুলোকে এই ধরনের সংঘাত এড়ানোর জন্য একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং সুষম বাণিজ্য নীতি অনুসরণের মাধ্যমে এটি সম্ভব।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধ: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধ করার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়ন এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা জরুরি। সরকারগুলোকে কৃষি খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাস করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন: টেকসই কৃষি প্রযুক্তি, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি: খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলকে স্থিতিশীল করতে স্থানীয় কৃষকদের সহযোগিতা এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষি প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া এই সংকট সমাধানে সাহায্য করতে পারে।
অর্থনৈতিক সংস্কার: মুদ্রাস্ফীতি ও অবমূল্যায়ন রোধে সুসংগঠিত মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা এবং বৈদেশিক ঋণের চাপ কমানো জরুরি। সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সংস্কার গ্রহণ করে দেশীয় অর্থনীতি স্থিতিশীল করা সম্ভব।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো পরিকল্পনা, খাদ্য উৎপাদন ও বিতরণ উন্নত করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো খুবই জরুরি। জলবায়ুর প্রভাব কমানো, সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা এবং দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ালে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব। একসঙ্গে চেষ্টা করলে আমরা এই সংকট কাটিয়ে টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে পারব।