বাংলাদেশ ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ করে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেতে যাচ্ছে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি এই উত্তরণের সুপারিশ করে। এ অর্জন শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং সমগ্র জাতির জন্য একটি গৌরবময় অধ্যায়। লাওস এবং নেপালও বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। যা দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্যও একটি বড় অর্জন।
কেন এই উত্তরণ গুরুত্বপূর্ণ?
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণ বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের জন্য নতুন পরিচিতি ও সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে।
বৈশ্বিক ব্র্যান্ডিং: বাংলাদেশের উন্নত অর্থনীতি, ক্রমবর্ধমান বাজার এবং উদ্যোমী কর্মশক্তির বার্তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে।
আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ: উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলবে।
অর্থনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি: এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের অর্থ হলো, বাংলাদেশ এখন আরও শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামোর অধিকারী এবং প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত।
উত্তরণের জন্য শর্ত:
একটি দেশকে স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য তিনটি মূল মানদণ্ড পূরণ করতে হয়:
দারিদ্র্য: মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত মানদণ্ড। ২০১৮ সালের হিসাবে, কোনো দেশের মাথাপিছু জিএনআই (GNI) যদি ১০২৫ মার্কিন ডলারের কম হয়, তবে তাকে স্বল্পোন্নত হিসেবে ধরা হয়। আর এই তালিকা থেকে বের হওয়ার জন্য জিএনআই হতে হবে ১২৩০ ডলারের বেশি।
মানব সম্পদের দুর্বলতা: পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার মানদণ্ডের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়।
অর্থনৈতিক দুর্বলতা: কৃষি উৎপাদনের অস্থিরতা, রফতানি কার্যক্রমের অস্থিরতা, অর্থনীতির ছোট আকার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতির মতো বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করা হয়। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ৪৬টি দেশ এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে, ১৯৯৪ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ছয়টি দেশ উন্নয়ন ঘটিয়ে এই তালিকা থেকে বের হয়ে গেছে। জাতিসংঘের তালিকা অনুযায়ী, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) স্বল্পোন্নত দেশগুলোর রফতানি বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ আকর্ষণে বিশেষ সহায়তা প্রদান করে। এর ফলে, এই দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
সম্ভাবনা সমূহ:
উন্নয়নশীল দেশের সম্ভাবনা সমূহ নিম্নে আলোকপাত করা হলো-
বাণিজ্যের সুযোগ বৃদ্ধি:
উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আরও সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছাবে। বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে, যার মাধ্যমে রফতানি আয়ের পরিমাণ বাড়বে। বর্তমানে তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের রফতানির বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। তবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ার পর তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়া শিল্প, কৃষি পণ্য এবং হস্তশিল্পের মতো নতুন খাতগুলোও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় আরও সুবিধাজনক অবস্থান নিতে পারবে। এ ছাড়া, উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় থাকা অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও গভীর করার সুযোগ তৈরি হবে।
শিল্পায়নের প্রসার:
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পায়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে পারবে। বিশেষত পোশাক শিল্পের মতো তথ্যপ্রযুক্তি খাত একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সফটওয়্যার রফতানি এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ে সাফল্য অর্জন করেছে। উন্নয়নশীল দেশের সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকে আকর্ষণ করে এই খাতকে আরও বিস্তৃত করা যাবে। বর্তমানে দেশের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করার পাশাপাশি রফতানিতেও ভূমিকা রাখছে। অপরদিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়িয়ে ঔষধ খাত আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে।
কৃষিভিত্তিক শিল্পে প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং রফতানির সুযোগ তৈরি হলে গ্রামীণ অর্থনীতিও আরও সমৃদ্ধ হবে। এটি কৃষি পণ্যের প্রসেসিং, প্যাকেজিং এবং আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
আত্মনির্ভরশীলতার বিকাশ:
উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ কমে যাওয়া। তবে এটি বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে একটি ইতিবাচক দিক হতে পারে। বিদেশি ঋণ এবং সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বাংলাদেশ নিজস্ব সম্পদ, কর্মশক্তি এবং দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে আরও আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও নীতিমালা সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। উদাহরণ স্বরূপ- কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, ছোট ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে উদ্ভাবনী ধারণা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আর্থিক সচ্ছলতা অর্জন সম্ভব।
আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার জন্য পণ্যের মান উন্নত করার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। এর পাশাপাশি, শিক্ষিত জনশক্তি এবং প্রযুক্তি দক্ষতার উন্নয়ন দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।
উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে। বাণিজ্যের প্রসার, শিল্পায়নের বিকাশ এবং আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন—এই তিনটি ক্ষেত্রের ওপর মনোযোগ দিয়ে দেশটি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারবে। সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্ভাবনী উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়- উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে বাংলাদেশের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ ও করণীয় রয়েছে-
শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানো:
স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) হিসেবে বাংলাদেশ অনেক আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা পেয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের “Everything But Arms (EBA)” সুবিধা, যা বাংলাদেশের পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। তবে, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর এই সুবিধাগুলি ক্রমান্বয়ে কমে আসতে পারে। এর ফলে তৈরি পোশাক খাতসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্য বিদেশি বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানির বড় একটি অংশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার বাজারে যায়। শুল্কমুক্ত সুবিধা হারালে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে এবং পণ্যের দাম প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বেশি হতে পারে। যেমন: ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়া, যারা এখনও শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করে, তাদের তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়তে পারে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে বাংলাদেশকে পণ্যের মান উন্নয়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি, নতুন বাজার অনুসন্ধান এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। একইসঙ্গে, স্থানীয় শিল্পের বৈচিত্র্যকরণ এবং উচ্চমূল্য সংযোজনকারী পণ্য উৎপাদনে জোর দিতে হবে।
তৈরি পোশাক শিল্পের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি, জাহাজ নির্মাণ, ওষুধ এবং কৃষিভিত্তিক রপ্তানিতে জোর দিতে হবে।
বৈষম্য ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি:
উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। সেটি হলো আঞ্চলিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নয়ন এখনও সমানভাবে হয়নি। যেমন: রাজধানী ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রীয়করণ দেখা যায়, যা গ্রামীণ এলাকাগুলোর উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান এবং মৌলিক সেবা (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অবকাঠামো) নিশ্চিত করা কঠিন হতে পারে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন:
*আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, যা দেশের প্রতিটি অঞ্চলের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাবে।
*কারিগরি ও পেশাভিত্তিক শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে।
*দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিশ্চিত করা।
*গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পে বিনিয়োগ। এছাড়া নারী, শিশু এবং পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি, যা সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকে আরও শক্তিশালী করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ:
বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়মিতভাবেই দেশের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে জলবায়ু অভিযোজনের জন্য সাহায্য পাওয়ার সুযোগ কিছুটা কমে যেতে পারে।
এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশকে:
*জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্প (যেমন: নদীখাল পুনঃখনন, বাঁধ নির্মাণ এবং বন্যাপ্রতিরোধী অবকাঠামো) গ্রহণ করতে হবে।
*পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি এবং সবুজ জ্বালানি ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে।
*আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।
এছাড়া, কৃষিক্ষেত্রে জলবায়ু সহনশীল ফসলের চাষ ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।
উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জও আসবে। শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানো, সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এই চ্যালেঞ্জগুলিকে কৌশলগতভাবে মোকাবিলা করলে বাংলাদেশ একটি টেকসই ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তুলতে পারবে।
বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ একটি জাতীয় অর্জন। যা প্রমাণ করে যে সঠিক পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে কোনো লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। ২০২৬ সালে এই উত্তরণ দেশের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে, যেখানে নতুন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সম্ভাবনার জোয়ার আসবে। সঠিক নীতি ও কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী, আত্মনির্ভরশীল এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সক্ষম উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে স্থান করে নিতে পারবে।