সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের নতুন এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, অনেক দেশ কভিড-১৯ মহামারীর কারণে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বাবদ ২০২৩ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলো রেকর্ড ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে। সামগ্রিক ঋণ পরিস্থিতিতে বিষয়টি প্রভাব ফেলেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপরে।
ইউরো নিউজ ও দ্য ন্যাশনাল এর আরেক প্রতিবেদনে উঠে আসে, ২০২৩ সালে ঋণগ্রহণ ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছিল। উচ্চতর মূল্যস্ফীতির কারণে ওই সময় সুদহার ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছায়। এছাড়া ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান কমে যাওয়া এবং বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে অনিশ্চয়তা ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে। বিশেষ করে দরিদ্রতম দেশগুলোয় এসব ধাক্কা সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সদস্যভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) থেকে সহায়তা পায়, এমন দেশগুলো গত বছর ঋণ বাবদ ৯ হাজার ৬২০ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে সুদ দিয়েছে সর্বকালের সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৪৬০ কোটি ডলার। আইডিএ থেকে ঋণ পাওয়ার যোগ্য দেশগুলোয় রফতানি আয়ের প্রায় ৬ শতাংশ এখন সুদ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে, যা ১৯৯৯ সালের পর সর্বোচ্চ।
কভিড-১৯ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রায় দেশই কমবেশি প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে। তবে এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলো। এসব দেশের জন্য ঋণের উৎসও কমে এসেছে। এ কারণে বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলো এখন তাদের ভরসাস্থল।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ইন্দরমিত গিল বলেন, ‘দরিদ্র অর্থনীতিগুলো যখন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অগ্রাধিকার ব্যয়ে ভারসাম্য রাখতে সংগ্রাম করছে, তখন বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।’
বিশ্বব্যাংকের নতুন বলছে, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান এ প্রবণতা থেকে ভিন্ন ছিল। ২০২২ ও ২০২৩ সালে আইডিএ থেকে ঋণ পাওয়ার যোগ্য দেশগুলোয় ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার বেশি ঋণ বিতরণ হয়েছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বা ২ হাজার ৮১০ কোটি ডলার দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
প্রতিবেদনে কিছু ইতিবাচক দিকও উঠে এসেছে। যেমন ২০২৩ সালে নিম্ন আয় বা মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জিএনআই (গ্রস ন্যাশনাল ইনকাম) নির্ভর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিছুটা স্থিতিশীল ছিল। চীন বাদ দিয়ে হিসাব করলে এ দেশগুলোর ঋণ ও জিএনআই অনুপাত গত বছর দশমিক ৮ শতাংশীয় পয়েন্ট কমেছে। তবে আইডিএর ঋণ পাওয়ার যোগ্য দেশে এ চিত্র আলাদা। তাদের ঋণ ও জিএনআই অনুপাত ১ দশমিক ৯ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে।
ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সের (আইআইএফ) এক প্রতিবেদন অনুসারে, এ বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) বৈশ্বিক ঋণ ১২ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বেড়ে রেকর্ড ৩২৩ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বছরের শেষে বৈশ্বিক ঋণ ৩২০ ট্রিলিয়নে স্থিতিশীল হতে পারে, তবে ২০২৫ সাল ও পরবর্তী সময়ে এটি আরো বাড়তে পারে। এতে মূল প্রভাবক হতে পারে সরকারি ব্যয়।
অর্থনৈতিক এ বিপর্যয়ে ‘ঋণখেলাপি’ এখন অতিচর্চিত শব্দে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর বেশির ভাগ দেশ সংকটের মুখোমুখি হয়ে ঋণখেলাপি যাতে না হয়, সে ঝড় সামলানোর চেষ্টা করেছে। নতুন ঋণ পাওয়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন থাকলেও দেশগুলো ঋণমান বজায় রাখতে চেষ্টা করেছে।
ঋণদাতাদের অর্থ ফেরত দিতে অনেক দেশকে বাজেটের অন্য অংশে কাটছাঁট করতে হয়েছে। আবার অনেক দেশ বিশ্বব্যাংক থেকে পাওয়া অর্থ বিকল্প ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করেছে। এ সংকটকালে বিশ্বব্যাংক কম সুদে ঋণ দেয়া থেকে সরে এসে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে অনুদান দিতে শুরু করে। প্রতিবেদনে আরো বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক এখন ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করছে, যাতে তারা এমনভাবে ঋণ পুনর্গঠন করতে পারে, যাতে সামাজিক বিনিয়োগ কমানোর প্রয়োজন না হয়।
এ পরিস্থিতিতে সার্বভৌম ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে ইন্দরমিত গিল বলেন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যেমন ঋণ পুনর্গঠন করতে পারে, তেমনি দেশগুলোরও ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ থাকা উচিত, যেন নতুন ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা ব্যাহত না হয়।আন্তর্জাতিক অবিশ্বাসের যুগে এ নীতিগুলো প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন হবে। তবে এর বাস্তবায়ন ছাড়া প্রধান সব উন্নয়ন লক্ষ্যই ঝুঁকিতে থাকবে।