পদ্মা সেতু, যা বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। যদিও এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে মোট ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। মাওয়া থেকে জাজিরা পয়েন্টে নির্মিত ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুটি দেশের অর্থনীতিতে এক বিশাল পরিবর্তন আনলেও এর নির্মাণ ব্যয় নিয়ে সমালোচনা থামছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- পদ্মা সেতুর ব্যয় অনেক বেশি, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় অস্বাভাবিক।
বর্তমানে পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বা টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চলছে। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) এক সমীক্ষায় বলেছে- দ্বিতীয় সেতু বা টানেল নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ২০ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা, যা বর্তমান পদ্মা সেতুর ব্যয়ের চেয়ে ৩২ শতাংশ কম। তবে সেতু নির্মাণের জন্য এখনো কোনো সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা পদ্মা সেতুর ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে অপ্রাসঙ্গিক অনেক খাতে অর্থ ব্যয় হয়েছে। সেতুর জন্য ক্যান্টনমেন্ট তৈরি, স্থায়ী প্রকিউরমেন্ট এবং ৩৬টি বাংলো নির্মাণসহ অনেক কাজ প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়েছে।’
পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের বিশ্লেষণ বলছে, মূল সেতুর নির্মাণকাজে খরচ হয়েছে ১২ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। নদীশাসনে ৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা এবং সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এলাকায় ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা।
জাইকার সমীক্ষায় দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বা টানেল নির্মাণে বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের হিসাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পূর্ত কাজের জন্য ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। ভূমি অধিগ্রহণে ৬০ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং ভ্যাট ও শুল্ক বাবদ ৩ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জাইকার হিসাব অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন বাস্তব চিত্রের চেয়ে বেশি হতে পারে।
ড. সামছুল হক বলেন, ‘জাইকা সাধারণত তার নিজস্ব নকশা ও পছন্দের ঠিকাদারদের মাধ্যমে কাজ করে। এতে ব্যয় বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সঠিক দরকষাকষির মাধ্যমে এর চেয়ে কম খরচে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব।’
জাইকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ থেকে ২০৩২ সালের মধ্যে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বা টানেলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হতে পারে। এ সময়ের মধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, নকশা প্রণয়ন এবং নির্মাণকাজের বিভিন্ন ধাপ সম্পন্ন হবে।
তবে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, আপাতত দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বা টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা স্থগিত রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের অন্যান্য অঞ্চলের উন্নয়নকেও গুরুত্ব দিতে হবে। ভোলা বা অন্যান্য এলাকায় সেতু নির্মাণের চাহিদা বেশি। এসব বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
পদ্মা সেতুর বর্তমান ব্যবহার এবং এর উপযোগিতা পর্যবেক্ষণের ওপরও জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সেতু উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা পদ্মা সেতুর ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করব এবং এরপরই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দেশের যোগাযোগ অবকাঠামোর সামগ্রিক উন্নয়নই আমাদের লক্ষ্য।’
পদ্মা সেতুর উচ্চ ব্যয় এবং দ্বিতীয় সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও দেশের উন্নয়নের প্রয়োজনে যোগাযোগ অবকাঠামোর বিস্তার অপরিহার্য। তবে প্রতিটি প্রকল্পে ব্যয়ের স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বা টানেল নির্মাণ হলে তা দেশের অর্থনীতি ও জনগণের জীবনযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করবে।

