বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার প্রবণতা দীর্ঘদিনের। প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন লাখ বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্য ভারতমুখী হন। তবে সাম্প্রতিক ভিসা সীমাবদ্ধতা এই ধারা ব্যাহত করেছে। প্রথমে এটি অসুবিধাজনক মনে হলেও, বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্য একটি বিরল সুযোগ হতে পারে।
স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবার দুর্বলতা এবং রোগীদের বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা কমিয়ে আনার এখনই সময়। স্বাস্থ্যখাতে আস্থা পুনর্গঠনের এই সুযোগ কাজে লাগানো গেলে, দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরও স্বনির্ভর ও রোগী-কেন্দ্রিক করা সম্ভব হবে।
ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা সারজিস (ছদ্মনাম) অভিজ্ঞতা স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবার প্রতি মানুষের আস্থার অভাব স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। ২০২০ সালে তার ওভারিয়ান সিস্ট অপসারণের পর বায়োপসি রিপোর্টে ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি কেমোথেরাপি নিতে প্রস্তুত হলেও পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে চিকিৎসকদের অসতর্কতা ধরা পড়ে। এর ফলে বাধ্য হয়ে তিনি মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে যান, যেখানে তার আগের অপারেশনকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সঠিক চিকিৎসা পেয়ে তিনি সুস্থ হন।
অন্যদিকে, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অহিদুর রহমানের অভিজ্ঞতা আরও একটি গুরুতর চিত্র তুলে ধরে। ২০১৯ সালে ঢাকার দুটি হাসপাতালে হৃদরোগজনিত সমস্যার ভুল ডায়াগনোসিসের শিকার হন তিনি। পরে ব্যাঙ্গালুরুর ডা. দেবী শেঠীর তত্ত্বাবধানে জানা যায়, কোনো ব্লকেজই নেই। শুধুমাত্র ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হন। এই অভিজ্ঞতার ফলে তিনি বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারান।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৬৬টি সরকারি হাসপাতাল এবং প্রায় ৫০০০ বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র থাকলেও চিকিৎসার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। দ্রুত কনসালটেশন, ভুল ডায়াগনোসিস, চিকিৎসকদের অমনোযোগিতা এবং উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় রোগীদের বিদেশে যেতে বাধ্য করছে।
অন্যদিকে ভারতীয় হাসপাতালগুলোতে শুধু দক্ষ চিকিৎসা নয়, রোগীদের প্রতি মানবিক এবং সহানুভূতিশীল আচরণও নিশ্চিত করা হয়। ফলে কার্ডিওলজি, অনকোলজি এবং গ্যাস্ট্রোএনটেরোলজির মতো জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশি রোগীরা কলকাতা, চেন্নাই, ভেলোর এবং মুম্বাইয়ের মতো জায়গায় যেতে বেশি আগ্রহী।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের ভিসা সীমাবদ্ধতা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্য একটি পরিবর্তনের দ্বার উন্মোচন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির অধ্যাপক রুমানা হক বলেন, “জটিল রোগের ক্ষেত্রে দক্ষ চিকিৎসক এবং উন্নত প্রযুক্তি আমাদের দেশে এখনও যথেষ্ট নেই। তবে যেখানে দক্ষ চিকিৎসক রয়েছেন, সেখানেও রোগীদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয় না।”
ল্যাবএইড হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা এ এম শামীমের মতে, “চিকিৎসকদের কারিগরি দক্ষতা ভালো হলেও রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগে উন্নতি প্রয়োজন।”
আইচি মেডিক্যাল গ্রুপের অধ্যাপক মো. মওজেম হোসেন বলেন, “উন্নত প্রযুক্তি, সাশ্রয়ী চিকিৎসা ব্যয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা জরুরি।”
ভারতের ভিসা সীমাবদ্ধতা দেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্য একটি জাগরণের সুযোগ তৈরি করেছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে যদি স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন করা যায়। তবেই বিদেশমুখী চিকিৎসার প্রবণতা কমানো সম্ভব হবে। অন্যথায় বিদেশে চিকিৎসার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এটি দেশের অর্থনীতি এবং জনগণের ওপর দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকে শক্তিশালী করা এখন সময়ের দাবি। এই মুহূর্তে গৃহীত পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যতে দেশীয় স্বাস্থ্যসেবার প্রতি রোগীদের আস্থা পুনঃস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।