২০২৪ সাল বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের জন্য একটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বছর ছিল, যার সূচনা হয়েছিল জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচনের পরের মাসগুলিতে রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং সামাজিক অস্থিরতা ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের পরিকল্পনায় বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, জনবিক্ষোভ, সহিংসতা, সেনাবাহিনীর মোতায়েন এবং কারফিউ পরিস্থিতি ব্যবসার পরিবেশকে একেবারে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল।
মধ্যবর্তী সময়ে, জুলাই মাসে ছাত্রনেতৃত্বাধীন প্রতিবাদ এবং সরকার বিরোধী আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে, যার পরিণতিতে আগস্টের শুরুতে সরকারের পতন ঘটে। এই রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলোর ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মারাত্মকভাবে অবনতির দিকে চলে যায়, যা উৎপাদন লাইনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন করে তোলে। ফ্যাক্টরি ও কারখানায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটতরাজের আশঙ্কা বাড়ে, ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্ভাবনা গভীর হয়ে ওঠে।
একই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি অস্বাভাবিক ব্যবসায়িক পরিবেশের মুখোমুখি হয়। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অস্থিরতা, কাঁচামালের আমদানিতে ডলারের সংকট এবং টাকার অবমূল্যায়ন এই চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে অন্যতম। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের অনিশ্চয়তা উৎপাদন খরচকে বৃদ্ধি করে, যা ব্যবসায়ী সমাজের জন্য আরও বিপদজনক হয়ে ওঠে।
এছাড়া ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার এবং শ্রমিক অসন্তোষ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। শ্রমিকদের অসন্তোষের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং বিশেষ করে পোশাক শিল্পে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
এ বছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অতি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, যা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। ২০২৪ সালের নভেম্বরে মুদ্রাস্ফীতির হার ১১.৩৮ শতাংশে পৌঁছায়। যা একে একটি মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট হিসেবে চিহ্নিত করে। ব্যবসায়ীরা এই মুদ্রাস্ফীতির জন্য খাবার ও অখাদ্য সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে বিঘ্নকে দায়ী করেছেন।
ফাস্ট-মুভিং কনজিউমার গুডস (এফএমসিজি)-এর খুচরা বিক্রি ৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা একটি স্পষ্ট সংকেত যে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ব্যবসায়ী নেতা জাভেদ আখতার। যিনি ইউনিলিভার বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ২০২৪ সালকে ব্যবসায়ী সমাজের জন্য অত্যন্ত কঠিন বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বিশেষভাবে খাদ্য ও অখাদ্য সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এরপর স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন ব্যবসায়িক পরিবেশে আরও চাপ সৃষ্টি করে। ইউএস ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া আমদানির খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং ব্যবসায়িক মার্জিনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। টাকার অবমূল্যায়ন আমদানির সাথে সম্পর্কিত ক্রেডিট কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করেছে, যার ফলে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস পেয়েছে।
এদিকে এলসি খোলার সমস্যা ব্যবসায়ীদের জন্য আরও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ডলারের অভাবে এলসি খুলতে না পারার কারণে ব্যবসায়ীরা উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন হন। প্রান-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, এলসি খোলার সমস্যা রপ্তানি ও উৎপাদন পর্যায়ে বিশাল প্রভাব ফেলছে। যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে।
একই সময়ে শ্রমিকদের অসন্তোষ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সরকার ব্যবসায়িক পরিবেশে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে।
সব মিলিয়ে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা গেছে। তবে এটি সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করছেন।