মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ৯০ দিনের জন্য বিদেশি সহায়তা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি সহায়তা কেবল যে মানবিক সহায়তা তা নয়, বরং এর উদ্দেশ্য বহুবিধ। মানবিক সহায়তার পরিমাণ খুবই কম। বরং সেই তুলনায় সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার পরিমাণ অনেক বেশি।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র ২০২৩ সালে ৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার মধ্যে সামরিক সহায়তা বন্ধ হলে বিশ্বের কিছু মানুষের জীবনে শান্তি আসবে, সে কথা বলাই যায়। যদিও ইসরায়েল ও মিসরকে দেওয়া অস্ত্র সহায়তা অব্যাহত থাকবে। ৯০ দিন পর তারা এই কর্মসূচি পর্যালোচনা করবে। অর্থাৎ সহায়তা হয়তো চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে না।
এমন পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএন , নিউইয়র্ক টাইমস, এএফপির একাধিক প্রতিবেদনে উঠে আসে। যা বিষয়টি খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই আদেশের ভালো ও মন্দ উভয় দিকই আছে।
দুই বছর ধরে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণার সময় যে অভিযোগ সবচেয়ে বেশি করেছেন, তা হলো ইউক্রেনকে যুদ্ধ সহায়তা দেওয়া। ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক এভাবেই বলতেন, প্রতিবার জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রে এলে বা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা হলেই কয়েক শ কোটি ডলারের সহায়তা প্যাকেজ হাতিয়ে নিচ্ছেন। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ১৮৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তার অঙ্গীকার করে; তত দিনে ৮৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ৮ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার দেওয়া হয়ে গেছে। এরপর গত ডিসেম্বর মাসেও যুক্তরাষ্ট্র আরও ১০০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে ইউক্রেনকে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগীরা শুরু থকেই এই সহায়তার সমালোচনা করে আসছেন। তাঁদের বক্তব্য, এটা যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের অর্থ। এই অর্থের মূল হকদার মার্কিন নাগরিক, জেলেনস্কি নন। কিন্তু তৎকালীন বাইডেন প্রশাসন জাতীয় ঋণের বোঝা বাড়িয়েও এই যুদ্ধে সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। ফলে গত দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকবার শাটডাউনের মুখে পড়েছে; এমনকি ঋণখেলাপি হওয়ার পর্যায়েও চলে গেছে। ট্রাম্প ঠিক এখানেই আঘাত করেছেন। তিনি অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদী। সে কারণে তাঁর স্লোগান: ‘আমেরিকাই প্রথম’। এই অর্থ মার্কিন জনগণের সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় করা হরে তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে।
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তার দীর্ঘদিনের ধারা থেকে সরে গেলেন ট্রাম্প। অক্সফামের যুক্তরাষ্ট্র শাখার প্রেসিডেন্ট অ্যাবি ম্যাক্সম্যান বিবৃতিতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটের মাত্র ১ শতাংশ ব্যয় হয় মানবিক ও উন্নয়ন সহায়তায়। এই সহায়তা মানুষের জীবন বাঁচায়, রোগবালাইয়ের সঙ্গে লড়াই করতে সাহায্য করে, লাখ লাখ শিশুকে শিক্ষার আলো দেখায় এবং দারিদ্র্যের হার হ্রাস করে।
২০০০ সালে ট্রাম্পের একটি বই প্রকাশ পায়। ‘দ্য আমেরিকা উই ডিজার্ভ’ নামে ওই বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘ইউরোপ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিলে প্রতিবছর এই দেশের (যুক্তরাষ্ট্রের) লাখ লাখ ডলার বেঁচে যাবে।’ এমনকি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যাটো থেকে প্রত্যাহারের হুমকিও দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এবারের নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও আবার তা বলেছেন।
বাস্তবতা হলো, ট্রাম্প ন্যাটোর অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে যেটা হবে, তা হলো ইউরোপের সমারিক ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে এত দিন যে স্থিতিশীলতা তারা ভোগ করেছে, তা থাকবে না। সেই দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় তার প্রভাব পড়বে। পরিণামে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের পোশাক রপ্তানিতেও তার প্রভাব পড়তে পারে।
ট্রাম্প ব্যবসায়ী মানুষ। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনীতিকের চেয়ে তাঁর ব্যবসায়ী সত্তাই কাজ করে। ফলে তিনি শুধু নগদ লাভ খোঁজেন, যদিও এর বাস্তবতা আছে। বিশ্বায়নের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং সেই মানুষেরাই ট্রাম্পের মূল সমর্থক। এবার তাঁর ভোট অনেকটাই বেড়েছে। মোট ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি কমলা হ্যারিসকে ছাড়িয়ে গেছেন; ২০১৬ সালে যেখানে তিনি হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে অনেক কম ভোট পেয়েও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ট্রাম্প গত সোমবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই ৯০ দিনের জন্য বৈদেশিক সহায়তা স্থগিত করে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। তবে এ আদেশ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
সামরিক সহায়তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে এটা তারা এত দিন করে এসেছে। উদারনীতিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় এটা করতে হয়েছে। কিন্তু ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প বৈশ্বিক নেতৃত্ব থেকে সরে আসার কথা বলেছেন। ন্যাটোর অর্থায়ন বন্ধের হুমকি দিয়েছেন। এবার তো শুরুতেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর অভিযোগ, চীনের জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশি হলেও তারা এই সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম চাঁদা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র এই সংস্থার সবচেয়ে বড় দাতা মোট তহবিলের ১৮ শতাংশের জোগান দেয় তারা।
তবে অনেকে বলছেন, উন্নয়ন সহায়তা বন্ধ হলে বিশ্বের অনেক দরিদ্র দেশ বিপাকে পড়বে। এ নির্দেশের ফলে এইডস ত্রাণবিষয়ক প্রেসিডেন্টের জরুরি পরিকল্পনা বা পিইপিএফএআরের তহবিল বন্ধ হয়ে যাবে। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোয়, বিশেষ করে আফ্রিকায় এইডসের চিকিৎসায় ওষুধ কেনা হয়। ২০০৩ সালের জর্জ ডব্লিউ বুশ পিইপিএফএআর চালু করেছিলেন। ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের জীবন বাঁচাতে এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।