বিশ্বব্যাংকের ঋণ দ্রুত ব্যবহার বাড়াতে ধীরগতির প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের ঋণ কেটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিশ্বব্যাংককে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের ৮১০ মিলিয়ন ডলার ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাতিল করা এই ঋণ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ‘রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড রিকভারি ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিট-২’ শীর্ষক বাজেট সহায়তা এবং ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বাংলাদেশ ক্লিন এয়ার প্রকল্পে ঋণ দেওয়া হবে।
সূত্র আরও জানায়, ঋণ বাতিলের পরিমাণ আরও বাড়বে। নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আরও কিছু চলমান প্রকল্প পর্যালোচনা চলছে। জরুরি ভিত্তিতে এবং নমনীয় শর্তের ঋণে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। একইসঙ্গে ঋণ বাতিলের পরিমাণ আরোও বাড়লে পাইপলাইনে আরও কয়েকটি জরুরি প্রকল্পের ঋণ দেওয়া হবে।
ইআরডি ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ১৬ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি বা প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের অর্থছাড় আটকে আছে ধীরগতির বাস্তবায়নের জন্য। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের চলমান আইডিএ-২০ সিলিং শেষ হয়ে যাওয়ার জরুরি বাজেট সহায়তা ঋণ বা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পেও নমনীয় ঋণ দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে যেসব প্রকল্পে এখনই অর্থছাড় ব্যবহার করা যাবে না, সেসব প্রকল্প থেক প্রতিশ্রুত ঋণের অংশ (যেটা ব্যবহার করা সম্ভব হবে না) কেটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আইডিএ-২০-এর আওতায় বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন দেশকে নমনীয় শর্তের ঋণ ও অনুদান দিয়ে থাকে।
সূত্র জানিয়েছে, কোন প্রকল্পে কী পরিমাণে ঋণ বাতিল হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে। ইআরডির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারাও এই পর্যালোচনায় অংশ নেন বলে জানা গেছে।
ইআরডির সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংক তিন বছরের ঋণ পরিকল্পনা নিয়ে ঋণ দেয়। বর্তমানে আইডিএ-২০-এর আওতায় বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে। আইডিএ-২০ আগামী জুনে শেষ হবে। তিন বছরভিত্তিক এই পরিকল্পনায় নমনীয় ঋণ বা কোর আইডিএ থেকে বাংলাদেশকে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া কথা। প্রথম দুই বছরে আইডিএ থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ফলে নমনীয় শর্তে আর ঋণ দিতে পারছে না বিশ্বব্যাংক। এ কারণে নমনীয় ঋণ নেওয়ার সুবিধার্থে ঋণ ভিন্নভাবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে সব প্রকল্প থেকে এখন ঋণ কেটে নেওয়া হচ্ছে না। পরে প্রয়োজন হলে ওইসব প্রকল্পে অতিরিক্ত অর্থায়ন বা পুনরায় ঋণ নেওয়ার সুযোগ থাকবে। আগামী জুলাই থেকে থেকে শুরু হওয়া আইডি-২১ থেকে এই প্রকল্পে বাড়তি অর্থায়ন করা হবে বলে বিশ্বব্যাংক ও ইআরডি সূত্রে জানা গেছে।
গত ২৭ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংকে এনহ্যান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (ইডিজিই) প্রকল্প থেকে ১১৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ বাতিলের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধি, সাইবার নিরাপত্তা উন্নত করা, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ২০১৮ সালে জানুয়ারিতে ২৯৫ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি সই হয়।
এছাড়া যেসব প্রকল্পে ঋণ বাতিলের প্রস্তাব বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার, পরিবেশ অধিদপ্তরের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (বিইএসটি) প্রকল্প থেকে ৬৫ মিলিয়ন ডলার, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর অ্যাডাপ্টেশন অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি রিডাকশন প্রকল্প থেকে ৬০ মিলিয়ন ডলার বাতিলের প্রস্তাব বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়েছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, চলমান প্রকল্পগুলো থেকে এখন পর্যন্ত ৮১০ মিলিয়ন ডলার ঋণ বাতিল করা হলেও ১০ প্রকল্পে ৫৬৪.১৩৮ মিলিয়ন ডলার ঋণ বাতিলের তালিকা টিবিএসের হাতে এসেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের বাংলাদেশ রোড সেফটি প্রজেক্ট থেকে ৭৫ মিলিয়ন ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে গত ১ ডিসেম্বর ইআরডি থেকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প থেকে এখন আরও ৭৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ বাতিলের জন্য আলোচনা চলছে। ফলে এই প্রকল্পে ঋণ বাতিল হবে ১৫০ মিলিয়ন ডলার। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ৩৫৮ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি সই হয় ২০২৩ সালের জুনে।
এই প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালল মো. আব্দুর রহিম বলেন, এই প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যখন চুক্তি সই হয়, তখন ১ ডলারের বিনিময়ে ৮৬ টাকা পাওয়া যেত। এখন ১ ডলার দিয়ে ১২০ টাকা পাওয়া যায়। ফলে এ প্রকল্পে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের পুরো ঋণ ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না। এ কারণে সকারের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১০০ মিলিয়ন ডলার ফেরত দেওয়া হয়েছে।
এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আমানউল্লাহ বলেন, রোড সেফটি প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আছে। ফলে এখনও বৈদেশিক ঋণছাড়ের সময় আসেনি। এখই বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না। রোড সেফটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শেষ হবে ২০২৮ সালে। যখন প্রয়োজন হবে, তখন বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে এই প্রকল্পের জন্য ফের ঋণ পাওয়া যাবে।
এদিকে যুব ও শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে নেওয়া অ্যাকসেলারেটিং অ্যান্ড স্ট্রেংদেনিং স্কিলস ফর ইকোনমিক ট্রান্সফরমেশন প্রকল্প থেকে বাতিল হচ্ছে ১০০.৩৭৮ মিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের অক্টোবরে এই প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি সই করে বাংলাদেশ।