গণঅভ্যুত্থানের ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রপ্তানিকারকরা সময়মতো উৎপাদন, রপ্তানি, কাঁচামাল আমদানি ও পরিবহন সংকটে পড়ায় কয়েকটি আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও ব্র্যান্ড এ দেশ থেকে কার্যাদেশ সরিয়ে নেয়। সারাবিশ্বে তৈরি পোশাকের বাজার ৮০০ বিলিয়ন ডলার। গত বছর দেশে গণআন্দোলনের সময় কিছু কার্যাদেশ ভারতে চলে যাওয়ায় বাজার দখলের বিষয়ে নয়াদিল্লি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে।
পোশাক রপ্তানিকারকদের আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর পরিকল্পনা ভারত সরকারের। বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে আরও বাধার মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গণআন্দোলনের পরপরই দেখা দেয় শ্রমিক অসন্তোষ। বেশ কয়েকটি কারখানা দুই-তিন মাস বন্ধ থাকে। এসব ঘটনা পোশাকশিল্পের সংকট আরও বাড়িয়ে তোলে। গত দুই বছর ধরে চলমান জ্বালানি সংকটের কারণে বেশ কয়েকটি বড় কারখানা সক্ষমতার কম উৎপাদনে বাধ্য হয়।
বড়দিন উপলক্ষে বিশ্ববাজারে পোশাক পাঠানোর সময় মূলত জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর। ক্রেতা-বিক্রেতার জন্য এটি ভরা মৌসুম। তাই জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলন পোশাক খাতের জন্য হিতে বিপরীত হয়। সেসময় রপ্তানিকারকরা চুক্তিমতো পণ্য পরিবহন ও জাহাজীকরণে হিমশিম খান। অনেকে বেশি টাকা খরচ করে উড়োজাহাজে পণ্য পাঠাতে বাধ্য হন।
ইউএস অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের তথ্য অনুসারে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ কমে হয় ছয় দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, ভারতের পোশাক রপ্তানি চার দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়ে হয় চার দশমিক চার বিলিয়ন ডলার।
তথ্য বলছে, সেসময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো বিকল্প হিসেবে ভারত থেকে পণ্য কেনায় বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমে যায়।
বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা বলছেন, শিল্পকারখানায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে শুরু করায় ও আইনশৃঙ্খলার ধীরে ধীরে উন্নতি হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে ভারতে যে কার্যাদেশ চলে গিয়েছিল, সেগুলো আবার ফিরতে শুরু করছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে পোশাক খাতে প্রচুর আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে আসা ভারত এ সুযোগকে কাজে লাগাতে আগ্রহী।
বর্তমানে ভারতীয় বস্ত্র-পোশাক খাতে উন্নতির জন্য কয়েকটি বড় সরকারি প্রকল্প আছে। এই খাতে আনুমানিক সাড়ে চার কোটি মানুষ কাজ করছেন। এর মধ্যে আছে প্রযুক্তি উন্নয়ন, দক্ষতা উন্নয়ন, সক্ষমতা বাড়ানো এবং অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ-জ্বালানি উন্নয়নে সরকারি সহায়তা। পাশাপাশি, আছে উত্পাদন প্রণোদনা ও শুল্ক সুবিধা।
ভারতের অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের সেক্রেটারি জেনারেল মিথিলেশ্বর ঠাকুর গত সপ্তাহে রয়টার্সকে বলেছিলেন, গত কয়েক মাস ধরে রপ্তানিকারকরা কার্যাদেশের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সুবিধার জন্য নতুন কিছু উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। শিগগিরই তা লোকসভায় তোলা হবে।
যেমন, ভারত সরকার বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ বর্তমান ৪৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন রুপি (৫১১ মিলিয়ন ডলার) থেকে ১০-১৫ শতাংশ বাড়ানোর কথা বিবেচনা করছে। আলোচনার সঙ্গে জড়িত এক সরকারি সূত্র রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছে।
সূত্রটি আরও জানায়, ভারত সরকার চলতি অর্থবছরে বস্ত্র-পোশাক খাতের জন্য উৎপাদন প্রণোদনার বরাদ্দ ৪৫০ মিলিয়ন রুপি থেকে বাড়িয়ে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন রুপি করতে পারে। এই প্রকল্পের অধীনে ভারত সরকার স্থানীয়ভাবে উত্পাদনকে উৎসাহিত করতে কর ছাড় দিচ্ছে।
টেক্সটাইল যন্ত্রপাতির পাশাপাশি পলিয়েস্টার ও ভিসকস স্ট্যাপল ফাইবারের মতো কাঁচামালের শুল্ক কমানোর বিষয়টিও বিবেচনায় আছে বলে অপর এক সরকারি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে।
সংবাদ সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে ভারতে কৃত্রিম সুতার ওপর আমদানি শুল্ক ১১ থেকে ২৭ শতাংশের মধ্যে আছে। বাংলাদেশে তা শূন্যের কোঠায়। এর প্রভাব পড়েছে ভারতীয় পোশাক রপ্তানিকারকদের ওপর।
অনেক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনছেন ইউরোপের এক শীর্ষ পোশাক বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে কিছু কার্যাদেশ বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে গেছে। তারা হয়ত অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা দেখতে পাচ্ছেন। আশা করা যায়, ক্রেতারা যদি মনে করেন বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল তবে তারা কার্যাদেশ নিয়ে ফিরে আসবেন।
২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় আসার পর রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর চাপ কমাতে ও রাষ্ট্রীয় সহায়তা ছাড়াই বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার প্রস্তুতি নিতে প্রায় সব খাতে রপ্তানি ভর্তুকি কমিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকার বিশ্ববাজারে রপ্তানির বাড়াতে রপ্তানি আয়ের ওপর এক থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা দেয়। আগের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ নগদ সহায়তার তুলনায় তা পাঁচ শতাংশ কম।
বাংলাদেশ ব্যাংক এক নোটিশে জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই সুবিধা আরও কমানো হয়েছে। সর্বোচ্চ হার ১০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন শূন্য দশমিক তিন করা হয়েছে। এ ছাড়াও. উৎপাদন খরচ বাড়লেও রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সুবিধা কমানো হয়েছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্য বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশ চীনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্ববাজারের সাত দশমিক চার শতাংশ দখল করে এ দেশ ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। তথ্য অনুসারে, বিশ্ববাজারে ভারতের অবস্থান পঞ্চম বৃহত্তম। তাদের রপ্তানি ১৫ বিলিয়ন ডলার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, রাজনৈতিক সংকটের কারণে কিছু কার্যাদেশ ভারতে চলে গেছে এটা সত্য। তবে ভারত সরকার বহু বছর ধরেই পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের তুলনায় সেখানে শ্রম আইন কঠোর ও মজুরি বেশি হওয়ায় তারা এই খাতে ভালো করতে পারেনি।
ভারতে শ্রমিক ইউনিয়ন বেশ শক্তিশালী উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ভারত সরকার রপ্তানিকারকদের যে প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে তা অবশ্যই ডব্লিউটিওর নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে। তা না হলে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো প্রতিবাদ করবে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, মূলত রাজনৈতিক সংকটের কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে কার্যাদেশ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন চীনা পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করলে ভারতের কাছে কার্যাদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। চীন থেকে অনেক কার্যাদেশ অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করবে এমন সম্ভাবনা আছে। ভালো ব্যবসায়িক পরিবেশে ভালো দাম, গুণগত মান ও ক্যাটারিং ক্যাপাসিটি থাকায় দুই বছর আগেও ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও ইথিওপিয়া থেকে প্রচুর কার্যাদেশ বাংলাদেশে চলে আসে।
ফারুক হাসান আরো বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলি তাদের সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে চান না। দেশি রপ্তানিকারকরা গত বছর প্রচণ্ড চাপে পড়েছিলেন। তারা বস্ত্র-পোশাক খাতে শক্তিশালী হওয়ায় এখনো ভালো করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের ওপর আস্থা রেখেছে। দেশে বিপুল সংখ্যক কার্যাদেশ আসা এরই প্রমাণ। তাছাড়া, বাংলাদেশ তৈরি পোশাকে বৈচিত্র্য এনেছে। রপ্তানি পোশাকের একটি অংশ এখন বেশ দামি। ফলে খুচরা ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছে।
এমন পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের রপ্তানির সূচক এখন ঊর্ধ্বমুখী। গত জুন থেকে পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। তবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ১০ দশমিক ৪৮ শতাংশ কমে হয়েছে দুই দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, গত জুলাই পর্যন্ত পোশাক রপ্তানি দুই দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়ে তিন দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। আগস্টে সাত দশমিক ২০ শতাংশ বেড়ে তিন দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার ও সেপ্টেম্বরে ১৪ দশমিক ছয় শতাংশ বেড়ে হয়েছে তিন দশমিক শূন্য এক বিলিয়ন ডলার।
অক্টোবরে রপ্তানি ২২ দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়ে তিন দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার হয়। এই প্রবৃদ্ধি চলমান আছে। নভেম্বরে পোশাক রপ্তানি ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়ে তিন দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার ও ডিসেম্বরে ১৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়ে তিন দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। রপ্তানির প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভালো করছে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি জানান, ভারত সরকার শুধু আর্থিক সহায়তাই দিচ্ছে না, বিশ্ববাজার দখলের জন্য জোরদার বিপণন কার্যক্রমও শুরু করেছে। যেমন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে ‘ভারত টেক্স ২০২৫’ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। এটি ভারতের বৃহত্তম বস্ত্র প্রদর্শনী। আরও ক্রেতা আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা নিয়ে অনুষ্ঠানটি সাজানো হচ্ছে।