বাংলাদেশে ঋণের সুদহার ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেওয়ার পর থেকেই ক্রমশ বাড়তে শুরু করে। নতুন গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণের পর গত বছরের আগস্টে এই প্রবৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত হয়। একাধিকবার নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঋণের সুদহার ১৬ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এ ধরনের উল্লম্ফনে ব্যবসায় খরচ বেড়ে গেছে। যার প্রভাব সরাসরি ভোক্তাদের ওপর পড়ছে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়তি ব্যয় সামলাতে উৎপাদন খরচের সঙ্গে এই বোঝা যুক্ত করছে। যার ফলে পণ্যের দামও বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সুদহার বৃদ্ধি হলেও এটি উল্টো দাম বাড়ানোর একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কয়েকটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে সুদহারের এই বাড়তি চাপ স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ তাদের ইকুইটির তুলনায় বেশি, তাদের আর্থিক ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অনেক কোম্পানির ঋণ ও ইকুইটির অনুপাত বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছেছে।
ওষুধ খাতের এসিআই লিমিটেডের ঋণের পরিমাণ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ৬৮৭৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা ইকুইটির তুলনায় ৮.৫৬ গুণ। এই সময় তাদের আর্থিক ব্যয় ২১৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৫৩ কোটি টাকা।
বহুজাতিক কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের ঋণ ছিল ১৮৩৮ কোটি টাকা। যা ইকুইটির তুলনায় ৫.৯৪ গুণ। জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে তাদের আর্থিক ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৮৯ কোটি টাকায়। যেখানে আগের বছরে তা ছিল ৪৪ কোটি টাকা।
ইস্পাত খাতের জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের ঋণের অনুপাত ইকুইটির তুলনায় ২.৩৬ গুণ। ২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে তারা ব্যাংক ঋণের সুদ হিসেবে ১০২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯৫ কোটি টাকা।
জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, সুদহার বৃদ্ধির ফলে তাদের মুনাফায় বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানো হলেও এটি কার্যকর হয়নি। বরং এ খরচ ভোক্তাদের ওপর চাপানোর কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে এবং মূল্যস্ফীতি আরও উসকে যাচ্ছে।”
এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশীদও একই মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “সুদহার বৃদ্ধির কারণে নতুন বিনিয়োগ থেমে গেছে। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।”
ব্যবসায়িক নেতারা মনে করেন, সুদহারের এই ঊর্ধ্বগতি শুধু বেসরকারি খাতের জন্য নয়, সরকারের ঋণ পরিশোধ ব্যয় বাড়িয়েও অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি শিল্প ও ব্যবসার টেকসই উন্নয়নে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নের জন্য বিশেষজ্ঞরা সুদহার কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তারা মনে করেন, পুঁজিবাজার ও বন্ড মার্কেটের সম্প্রসারণ এবং ইকুইটি ফান্ডের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হলে অর্থনীতিতে ভারসাম্য আনা সম্ভব।
সরকারের উচিত নীতিমালায় স্থিতিশীলতা আনা এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে সংকট কাটিয়ে ওঠা। বিশেষজ্ঞরা আশাবাদী যে, যথাযথ পদক্ষেপ নিলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।