বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি এক চ্যালেঞ্জপূর্ণ সময় অতিক্রম করছে। কোভিড- মাসমহামারির পর ধীরে ধীরে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সরবরাহ শৃঙ্খলের বিপর্যয়, মুদ্রাস্ফীতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বৈশ্বিক অর্থনীতিকে টালমাটাল করে তুলেছে।
উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো মন্দার শঙ্কায় নীতিগত পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ, যেটি গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মাঝে কতটা স্থিতিশীল থাকতে পারবে? বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, বাণিজ্য ঘাটতি এবং বিনিয়োগ পরিবেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকগুলোর ভিত্তিতে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস চালানো হলো।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান চিত্র: বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ১০শতাংশ। তবে, সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের প্রভাবে অর্থনীতির গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে নামতে পারে, যা আগের পূর্বাভাসের চেয়ে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ কম। জ্বালানি সংকট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন শিল্পে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলেছে। ফলে পণ্যের দাম বেড়েছে। এটা আবার মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিয়েছে।
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে যে, ২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতি বিভিন্ন ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর মধ্যে রয়েছে চরম আবহাওয়া, বিশেষ করে বন্যা ও অতিরিক্ত তাপমাত্রা। এছাড়াও, পরিবেশ দূষণকেও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় বাঁধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য পাঁচটি প্রধান ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে-
- মূল্যস্ফীতি: উচ্চ মূল্যস্ফীতি জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে এবং জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটায়।
- চরম আবহাওয়া: বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং তাপপ্রবাহের মতো চরম আবহাওয়া কৃষি ও অবকাঠামোতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- পরিবেশ দূষণ: বায়ু, পানি এবং মাটির দূষণ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
- বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব: কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, যা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
- অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা: বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে।
তাছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন অত্যন্ত জরুরি। সম্পদ ও আয়ের অসম বণ্টন সমাজে অসন্তোষ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই, সরকারকে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী সম্প্রসারণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রানীতি: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মুদ্রানীতির মাধ্যমে বাজারে অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করা হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমেছে, যা নভেম্বর মাসে ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। যদিও এটি কিছুটা কমেছে, তবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মুদ্রাস্ফীতি ও এর ফলে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা ডিসেম্বরে কমে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ হয়েছে। পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন নাগাদ এটি ৭ শতাংশে এবং ২০২৬ সালের জুনে ৫ শতাংশে নামতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ঝুঁকিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। উচ্চ আমদানি ব্যয় ও সরবরাহ ব্যবস্থার ব্যাঘাতের কারণে মূল্যস্ফীতি দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চমাত্রায় থাকতে পারে। তাই, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কার্যকর মুদ্রানীতি ও নীতিগত সংস্কার জরুরি।
বৈদেশিক সহায়তা ও সংস্কার উদ্যোগ: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সংস্কার প্রচেষ্টায় সহায়তা করতে বিশ্বব্যাংক চলতি অর্থবছরে ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি নতুন অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক এই ঘোষণা দেন। তিনি জানান, এই অর্থায়ন সরকারের সংস্কার কার্যক্রম, বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন, বায়ু মান উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হবে।
এছাড়া, বিদ্যমান প্রকল্পগুলো থেকে আরও প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার পুনর্বিন্যাস করে মোট সহায়তা প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই অতিরিক্ত অর্থায়ন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের সমন্বয়ে প্রদান করা হবে। বিশ্বব্যাংকের এই সহায়তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও করণীয়: বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতা ও সম্ভাব্য মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশকে বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করতে হবে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কার্যকর সংস্কার এবং পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সংস্কার ও সুশাসন: বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতি দমন নীতির কার্যকর বাস্তবায়ন বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে। সরকারি নীতিমালার সংস্কার ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ সহজতর করতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম আরও দক্ষ ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে, যাতে ঋণখেলাপির সংখ্যা কমে এবং বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ে।
বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি: দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা, কর-প্রণোদনা এবং অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত না হয়। এছাড়া, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য স্থিতিশীল মুদ্রানীতি ও বাণিজ্য নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
রপ্তানি খাতের বৈচিত্র্যকরণ: বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলতঃ তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ভবিষ্যতে অর্থনীতিকে টেকসই করতে হলে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, ওষুধশিল্প, হালকা প্রকৌশল ও চামড়া শিল্পের মতো সম্ভাবনাময় খাতগুলোতে বিনিয়োগ ও রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে বৈশ্বিক আউটসোর্সিং বাজারের সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধি: অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি অপরিহার্য। বাংলাদেশে এখনো বিপুল সংখ্যক তরুণ শ্রমশক্তি রয়েছে, তবে তাদের অনেকেই দক্ষতার অভাবে উৎপাদনশীল খাতে যুক্ত হতে পারছে না। এই সমস্যা সমাধানে প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করতে হবে। কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা সম্প্রসারণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
সামাজিক সুরক্ষা ও দারিদ্র্য বিমোচন: দেশের নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা থেকে রক্ষা করতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধি বাড়াতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষাসুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। বেকারত্ব হ্রাস করতে যুবকদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা ও উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে।
জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ: বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামের অস্থিরতা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে। এই সমস্যা সমাধানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদ্যমান গ্যাস ও কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দক্ষতা বাড়াতে হবে।
অন্যদিকে, কৃষিখাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে, যাতে খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা কমে এবং দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এবং বাংলাদেশও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ প্রবাহের শ্লথগতি- এসব চ্যালেঞ্জ অর্থনীতির গতি কিছুটা শ্লথ করে দিয়েছে। তবে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখনও অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। শক্তিশালী রপ্তানি খাত, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বৈদেশিক সহায়তা অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখছে।
সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও এগিয়ে যেতে পারে। অর্থনৈতিক সংস্কার, বিনিয়োগবান্ধব নীতি, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করা গেলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারবে। এজন্য সরকার, বেসরকারি খাত এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।