চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে রাজস্ব আদায় ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বার্ষিক কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এমনকি স্থিতিশীল সময়েও রাজস্ব বোর্ড বার্ষিক করের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এ বছরের বাকি পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায় ২৮ শতাংশের মতো বাড়াতে হবে। এবার কর লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি আসতে ব্যর্থ হলে বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর বাজেট সহায়তা ও চলমান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তি আটকে যেতে পারে।
গত জুলাই থেকে জানুয়ারিতে রাজস্ব বোর্ড আদায় করেছে এক লাখ ৯৫ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দুই দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি। আয়কর, ভ্যাট ও শুল্কসহ সব ধরনের রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত জানুয়ারিতে টানা দ্বিতীয় মাসে রাজস্ব আদায়ে সাত শতাংশ মাসিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তা সত্ত্বেও চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে রাজস্ব বোর্ড প্রয়োজনীয় ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে।
বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আইএমএফসহ বহুপক্ষীয় ঋণদাতা সংস্থাগুলো চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশকে কর-জিডিপি অনুপাত দশমিক পাঁচ শতাংশ পয়েন্ট বাড়াতে চাপ দিচ্ছে।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান এমএ রাজ্জাক বলেন, জুলাই-জানুয়ারিতে আদায় প্রবৃদ্ধি কম হলেও তা অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ। রাজস্ব আদায়ের সার্বিক পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থেকে গেছে। যেটুকু প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেটা হয়ত বিগত সময়ের বকেয়া সমন্বয়ের কারণেই হতে পারে।
এমএ রাজ্জাকের মতে, গত জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় রাজস্ব বোর্ডের জন্য নজিরবিহীন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও, গত আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন ও চলমান সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে রাজস্ব আদায়ে ধীরগতি দেখা দিয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে উন্নয়ন খরচ হয়েছে ৫৯ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশ কম।
অর্থনীতিবিদ রাজ্জাক বলেন, ‘রাজস্ব প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার সঙ্গে বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি রাজস্ব বোর্ডের জন্য সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে।’
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পূর্বাভাসে ‘সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার পরে উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তা’ ও ‘তথ্য অপ্রাপ্যতা’ উল্লেখ করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এক দশমিক সাত শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে চার শতাংশ করেছে। মূল্যস্ফীতির চাপ রাজস্ব প্রবৃদ্ধিকেও বাধাগ্রস্ত করেছে। কারণ সাধারণ মানুষ বেশ কয়েক বছর ধরে কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছে।
রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুল মজিদও এই প্রবৃদ্ধিকে ‘শুভ লক্ষণ’ বলে মনে করেন। তিনি বলেন, তবে আমরা আরও ভালো প্রবৃদ্ধির আশা করেছিলাম। সাধারণত বিগত বছরগুলোর তুলনায় অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কর আদায় দ্রুত হয়।
অংশীজনদের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বিদ্যমান আইন প্রয়োগের অদক্ষতার কথা জানিয়ে বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ে আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই। শুধু অনুরোধ বা মৌখিক আলোচনায় ফল আসবে না।’
তিনবার সময়সীমা বাড়ানো সত্ত্বেও গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৩ হাজার ৬৬টি প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় এক কোটি ১৪ লাখ টিআইএনধারীর মধ্যে ৩৯ লাখ ৮৬ হাজার জন আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত রাজস্ব সংস্কার কমিটির সদস্য আবদুল মজিদ মনে করেন, আগামী বছরে রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্য হওয়া উচিত আরও বড় প্রবৃদ্ধির। মনে হয় না লক্ষ্যমাত্রা কমানো উচিত হবে। সারাবিশ্বে কর-জিডিপি অনুপাতের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম সর্বনিম্ন। অর্থাৎ, জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের অনেক সম্ভাবনা আছে। রাজস্ব বোর্ডের ব্যর্থতার কারণে আমরা পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় করতে পারছি না। এ নিয়ে কেউ উদ্বিগ্ন নন। এমনকি, সরকারও রাজস্ব বোর্ডকে জবাবদিহিতার আওতায় আনছে না।
রাজস্ব বোর্ড প্রাথমিকভাবে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিলেও তা কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা করা হতে পারে। এ ঘাটতি পূরণে রাজস্ব বোর্ডকে গত অর্থবছরের প্রকৃত রাজস্ব আদায়ের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ কর আদায় বাড়াতে হবে। সম্প্রতি সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা আরও কমাতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে রাজস্ব বোর্ড।