নিরাপদ বিনিয়োগ ও নিশ্চিত মুনাফার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ব্যাংকগুলো সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। তবে এটি ব্যাংকের মূল ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলো জনগণের আমানত সংগ্রহ করে ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদান করে এবং সুদের মাধ্যমে মুনাফা করে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কমলেও সরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, উচ্চ সুদের কারণে ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। তবে সম্প্রতি সরকারের ট্রেজারি বিলের সুদের হার কমে ১০ শতাংশে নেমে এসেছে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা থেকে ৯৯ হাজার কোটি টাকায় নামানো হয়েছে। এমনকি ধারণা করা হচ্ছে সরকার এ পরিমাণ ঋণও নেবে না। ফলে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে। অন্যদিকে যেসব ব্যাংকের তারল্য পর্যাপ্ত রয়েছে তারা সরকারি বিল-বন্ডে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ১০-১০.৩৫ শতাংশ সুদের হারে তিন হাজার ৪১৩.১৫ কোটি টাকার ট্রেজারি বিল বিক্রি করা হয়েছে। অথচ গত ডিসেম্বরে এই বিলের সুদের হার ছিল ১১.৯৭ শতাংশ আর ২০২৪ সালের জুনে ছিল ১২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ব্যাংকগুলো ভালো বিনিয়োগের সুযোগ না পেয়ে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মতো নিরাপদ উপকরণে বিনিয়োগ করছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেছেন, “ব্যাংকগুলো লাভজনক বিনিয়োগের খাত খুঁজে না পেয়ে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে আগ্রাসী দরপত্র দিচ্ছে, ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমিয়েছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকারের চাহিদা কম থাকলে সাধারণত ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার কমে যায়। অন্যদিকে, সরকারের চাহিদা বেশি থাকলে সুদহার বৃদ্ধি পায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কম থাকলেও ভালো ব্যাংকগুলো ঠিকই আমানত পাচ্ছে। অন্যদিকে, কিছু দুর্বল ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেওয়া হচ্ছে এবং ভালো ব্যাংকগুলোতে তা রাখা হচ্ছে। ফলে সুদহার কমলেও ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের পরিমাণ কমছে না।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলো সাধারণত উচ্চ রিটার্নের জন্য বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে চায়। তবে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে গেছে ফলে ব্যাংকের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ পড়ে থাকছে। সেই অর্থই এখন ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করা হচ্ছে যেখানে ঝুঁকি কম এবং লাভ নিশ্চিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭.২৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০২১ সালের অক্টোবরের পর সর্বনিম্ন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সরকার ৯১ দিনের, ১৮২ দিনের এবং ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিল নিলামের মাধ্যমে যথাক্রমে ১০.৩৫, ১০.২৪ এবং ১০.৩৫ শতাংশ সুদের হারে সাত হাজার ১৩২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অথচ গত ২ ফেব্রুয়ারির নিলামে একই মেয়াদের জন্য সুদের হার ছিল ১০.৮৫, ১০.৯৬ এবং ১০.৯৯ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর এসব ট্রেজারি বিলের সুদের হার ছিল ১১.৫০, ১১.৮৭ এবং ১১.৯৯ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রেজারি বিল হলো স্বল্পমেয়াদি সরকারি ঋণ গ্রহণের মাধ্যম, আর ট্রেজারি বন্ড দীর্ঘমেয়াদি ঋণের উপকরণ। সাম্প্রতিক সময়ে সুদের হার কমলেও বিনিয়োগকারীদের জন্য সরকারি বন্ড ও বিল এখনও নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।