এক সময় চীনের অন্যতম শীর্ষ ধনী জ্যাক মা গণপরিসর থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিলেন। ২০২০ সালের পর তাঁকে খুব একটা জনসমক্ষে দেখা যায়নি। চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের কঠোর সমালোচনা এবং সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে তিনি অনেকটাই আড়ালে চলে যান।
তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক সরকারি অনুষ্ঠানে তাঁকে সামনের সারিতে দেখা যায়। অনুষ্ঠানে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। যদিও পুরো সময় তিনি নীরব ছিলেন তবে অনুষ্ঠানের শেষদিকে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে করমর্দন করেন। এই মুহূর্তের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে জ্যাক মার মালিকানাধীন আলিবাবার শেয়ারের মূল্য ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। শুধু তাই নয় চলতি বছরে আলিবাবার শেয়ারের মূল্য প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে।
জ্যাক মার অনুসারী এবং বিশ্লেষকদের মতে, এই করমর্দন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অনেকেই মনে করছেন, এটি জ্যাক মার পুনর্বাসনের একটি ইঙ্গিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে চীনা সরকার প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের প্রতি তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনছে।
২০২০ সালে জ্যাক মা ছিলেন চীনের প্রযুক্তি খাতের সবচেয়ে সুপরিচিত মুখ। তাঁর কোম্পানি আলিবাবা বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে উঠেছিল। কিন্তু চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর মনোভাব নিয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্য করার পরপরই তিনি সমস্যায় পড়েন। সে সময় তাঁর প্রতিষ্ঠান অ্যান্ট গ্রুপের ৩৪.৫ বিলিয়ন ডলারের আইপিও বাজারে আসার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের অসন্তোষের কারণে সেই আইপিও বাতিল হয়ে যায়।
বিশ্লেষকদের মতে, চীন সরকার তখন বুঝতে পেরেছিল, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এবং বিশেষ করে জ্যাক মা অনেক বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠছেন। এর ফলে সরকার প্রযুক্তি খাতের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে যার ধাক্কা সরাসরি জ্যাক মার ওপরও পড়ে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়েছে। প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং আমদানি-রপ্তানির উপর নানা নিষেধাজ্ঞা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীন বড় ধরনের অর্থনৈতিক চাপে পড়ে। ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম মেয়াদে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয় যা চীনের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে সি চিন পিং দেশের বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন যার ফলে বিনিয়োগ ও ব্যবসা পরিচালনায় জটিলতা সৃষ্টি হয়।
এদিকে চলতি বছরে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর প্রশাসন চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা চীনের অর্থনীতির জন্য আরও কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই বাস্তবতায় চীনা সরকার ব্যবসায়ীদের প্রতি নীতি পরিবর্তন করছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে সরকারের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট—আগের মতো অনিয়ন্ত্রিত প্রবৃদ্ধি নয় বরং ব্যবসায়ীদের চীনের জাতীয় নীতি ও কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিচালিত হতে হবে।
সি চিন পিং বারবার “হাই কোয়ালিটি ডেভেলপমেন্ট” এবং “নিউ প্রোডাকটিভ ফোর্সেস”—এই দুটি ধারণার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। অতীতে চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি আবাসন ও অবকাঠামো খাতের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার সেই মডেল থেকে সরে এসে সেমিকন্ডাক্টর, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি এবং এআই-ভিত্তিক শিল্পের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। চীনের লক্ষ্য ২০৩৫ সালের মধ্যে “সোশ্যালিস্ট মডার্নাইজেশন” বা সমাজতান্ত্রিক আধুনিকায়ন অর্জন করা। এতে উচ্চ জীবনমান নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন খাতকে বিকশিত করা অন্যতম লক্ষ্য।
বিশ্লেষকদের মতে, চীনা সরকার বুঝতে পারছে যে, এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বেসরকারি খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের পরিবর্তে তাদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। জ্যাক মার পুনরাবির্ভাব এই পরিবর্তনেরই একটি ইঙ্গিত। সরকার এখন নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রযুক্তি খাতের বিকাশ ঘটাতে চায় এবং ব্যবসায়ীদের উদ্ভাবনে উৎসাহিত করছে।
১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন স্পুটনিক পাঠানোর পর যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তি উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ শুরু করেছিল। বর্তমান সময়ে এআই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনও একই ধরনের অবস্থানে রয়েছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন চ্যাটজিপিটির মতো চীনও ডিপসিক নামক এআই মডেল বাজারে এনেছে যা বিশ্ব প্রযুক্তি খাতে চীনের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডিপসিক চীনের জাতীয় গর্ব হয়ে উঠেছে। এর প্রভাব আর্থিক বাজারেও পড়েছে হংকংসহ চীনের মূল ভূখণ্ডের শেয়ারবাজারে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়েছে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্সের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চীনের প্রযুক্তি খাতে ২০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসতে পারে। এআই প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে চীনের রাজস্ব আয়ও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।
জ্যাক মার পুনরাবির্ভাব শুধু একজন ব্যবসায়ীর ফিরে আসার গল্প নয় এটি চীনের অর্থনৈতিক নীতির পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত বহন করে। দেশটির সরকার ব্যবসায়ীদের আরও সম্পৃক্ত করতে চাইছে তবে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। চীনের ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিনির্ভর প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত হচ্ছে যেখানে এআই এবং উদ্ভাবন মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে।