দেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ শাসনামলে এ খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন ভুয়া ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানায় থাকা ব্যক্তিরা লুটকৃত অর্থের ভাগ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে লুটপাটের তথ্য গোপন রাখার কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায়। ২০২৩ সালের একই সময় এটি ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ১৩২ কোটি টাকা।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৬.৯৩ শতাংশ। এতে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো ঠিকমতো প্রভিশন সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংকিং খাতের প্রতি জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে এই বিশাল অঙ্কের ঋণের বোঝা কমাতে হবে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৭ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা, যা তার মোট ঋণের ৭২ শতাংশ। একইভাবে, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯৫৩ কোটি টাকা (৪৩.৮৬%), অগ্রণী ব্যাংকের ২৭৯৩ কোটি টাকা (৩৮.৪৬%), রূপালী ব্যাংকের ১৫০৭৯ কোটি টাকা (৩১.৭৩%) এবং সোনালী ব্যাংকের ১৬৯০৫ কোটি টাকা (১৮.৬১%)।
অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা যা মোট ঋণের ১৫.৬০ শতাংশ।
ডলার সংকট কাটাতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের আওতায় ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামানোর শর্ত রয়েছে। তবে বাস্তবতা বলছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের হার নির্ধারিত মাত্রার অনেক ওপরে।
মন্দঋণের পরিমাণও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের মন্দঋণ ১ লাখ ২৪ হাজার ৪৪২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে যা ছয় মাস আগেও ছিল ৭৭ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। একই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মন্দঋণ ৭৭ হাজার ১৬০ কোটি টাকা বেড়ে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। বিশেষায়িত ব্যাংকের মন্দঋণ ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মন্দঋণ ২ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা হয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, জনতা ব্যাংকের মন্দঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি—৬২ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক, যার মন্দঋণ ২৪ হাজার ১২৬ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক (২৩৯৪০ কোটি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ (২০৪৮৭ কোটি), সোনালী ব্যাংক (১৫১৯৫ কোটি), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (১৫১৮০ কোটি) এবং রূপালী ব্যাংক (১৩৪০৭ কোটি)।
খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক খাতে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে অন্তত ১৩টি ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা।
প্রভিশন ঘাটতির দিক থেকে জনতা ব্যাংক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ঘাটতি ২৭ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক (১৮৭২০ কোটি), ইসলামী ব্যাংক (১৩১৫৩ কোটি), সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (১০৬০৩ কোটি) এবং সোনালী ব্যাংক (৯০৩০ কোটি)।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। ব্যাংকিং খাতে লুটপাট ও অনিয়ম রোধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে আইএমএফের শর্ত পূরণ করে খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর নীতিমালার মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে ওঠার পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুবা দেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে আরো বড় সংকটে পড়তে পারে।