একটি চাকরি—একটা জীবিকা, একটা পরিচয়, একটা স্বপ্ন। কিন্তু আজকের ডিজিটাল বিশ্বে এই চাকরির ধরনই দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কিছু পেশা হারিয়ে যাচ্ছে, আবার কিছু পেশার জন্ম হচ্ছে যেগুলোর নাম কয়েক বছর আগেও কেউ শোনেনি। এই পরিবর্তনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের তরুণরা—যারা একদিকে শিক্ষা জীবন শেষ করছে, আবার অন্যদিকে বুঝতে পারছে শুধু সার্টিফিকেট নিয়ে আর চলবে না। সময় এসেছে নিজেকে নতুন দক্ষতায় গড়ে তোলার।
প্রযুক্তির অগ্রগতি, বিশ্বায়ন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থানের কারণে এখন আর শুধু সার্টিফিকেট দিয়ে চলা যায় না।দরকার বাস্তবমুখী দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এবং পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা। চাকরি এখন আর শুধু “চাকরি” নয়, বরং একটি প্রতিযোগিতা—যেখানে টিকে থাকতে হলে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় সময়োপযোগী দক্ষতা দিয়ে। বর্তমান প্রজন্মের সামনে তাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ- এই পরিবর্তিত চাকরির বাজারে নিজেকে কীভাবে মানিয়ে নেওয়া যায়, আর কী কী দক্ষতা শেখা এখন অপরিহার্য? তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়—চাকরির বাজারে টিকে থাকতে বা সাফল্যের জন্য
আজকের তরুণদের কী কী দক্ষতা দরকার?
চাকরির বাজারে পরিবর্তনের পেছনে কী কারণ? বর্তমান চাকরির বাজার প্রতিদিনই বদলে যাচ্ছে। আগের তুলনায় এখন চাকরির জন্য প্রয়োজন এমন সব দক্ষতা, যেগুলো অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর এবং নানা দিক থেকে দক্ষতা চায়। আজকের চাকরিদাতারা এমন লোক খুঁজছেন যারা ভবিষ্যতের কর্মজগতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও দক্ষ, সহজ ও ফলপ্রসূভাবে কাজ করতে পারে।
চাকরির বাজারে পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় যে শক্তি কাজ করছে, তা হলো প্রযুক্তির অগ্রগতি।
এক দশক আগেও যেখানে সরকারি চাকরির নির্দিষ্ট নিয়মকানুন আর করপোরেট চাকরির একই রকম ধারার কাজই ছিল আমাদের চাকরির জগৎ, সেখানে এখন দৃশ্যপট একেবারেই পাল্টে গেছে। প্রযুক্তি শুধু কাজের ধরন নয়, কাজের প্রয়োজনীয়তাও বদলে দিয়েছে। এক সময় যে কাজগুলো কেবল মানুষই করতে পারত, এখন তার অনেকটাই করে নিচ্ছে মেশিন, সফটওয়্যার, এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ব্যাংকে গিয়ে লাইন দিয়ে টাকা তোলার দিন শেষ—এখন মোবাইল অ্যাপ থেকেই সব লেনদেন করা সম্ভব। গ্রাহকসেবার ক্ষেত্রেও মানুষ নয়, অনেক সময় স্বয়ংক্রিয় বট বা চ্যাটবট ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ চালিয়ে নিচ্ছে।
এই প্রযুক্তিনির্ভর পরিবর্তনের পাশাপাশি বিশ্ব এখন একে-অপরের আরও কাছে এসেছে। ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্ম যেমন: Fiverr, Upwork কিংবা Freelancer-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণরা আজ ঘরে বসেই কাজ পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যের ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে। কিন্তু এসব প্ল্যাটফর্মে টিকে থাকতে হলে দরকার আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা, সময়ানুবর্তিতা এবং পেশাদার আচরণ। শুধু ইংরেজি জানলেই হবে না জানতে হবে কীভাবে কাজ উপস্থাপন করতে হয়, ক্লায়েন্টের প্রয়োজন বুঝে তাকে সেবা দিতে হয়।
এছাড়া দেশে এবং বিশ্বজুড়ে করপোরেট সংস্কৃতিও পরিবর্তিত হয়েছে। আগে যেখানে চাকরি মানেই অফিসে গিয়ে বসে নির্দিষ্ট সময় ধরে কাজ করা, সেখানে এখন প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে উদ্ভাবনী চিন্তা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা। নিয়োগদাতারা এমন কর্মী খোঁজেন, যারা শুধু সনদ অর্জন করেনি, বরং বাস্তব জ্ঞান রাখে, নিজে থেকে উদ্যোগ নিতে পারে এবং নেতৃত্ব দিতে পারে।
এই সব পরিবর্তনের ফলে এখন আর চাকরি পাওয়া বা টিকে থাকার মাপকাঠি পুরনো নিয়মে চলে না। এখন যারা সময়ের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে, নতুন জ্ঞান শেখে এবং প্রযুক্তিকে নিজের দক্ষতায় রূপান্তর করতে পারে—তাদের হাতেই থাকবে ভবিষ্যতের চাকরির বাজার।
তাহলে কী কী দক্ষতা সবচেয়ে বেশি জরুরি?
বর্তমানে চাকরির বাজারে টিকে থাকার জন্য শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা আর ভালো ফলাফল যথেষ্ট নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে চাহিদা, আর সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে প্রয়োজনীয় দক্ষতাও। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে বর্তমান চাকরির বাজারের এক-চতুর্থাংশের বেশি অংশই বদলে যাবে। এর মানে হলো—যারা নিজেদের দক্ষতার ঝুলিকে নতুন জ্ঞান দিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারবে না, তারা ক্রমেই পিছিয়ে পড়বে। বিশেষ করে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন এবং অনলাইনভিত্তিক কাজের প্রসারের কারণে দক্ষতার ধরনই এখন একেবারে আলাদা হয়ে উঠেছে।
আজকের চাকরির বাজারে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কম্পিউটার চালানো, ইন্টারনেট ব্যবহারে পারদর্শিতা, প্রোগ্রামিং ভাষা যেমন: Python কিংবা JavaScript, গ্রাফিক ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং—এসবই এখন অনেক প্রতিষ্ঠানে বেসিক যোগ্যতার মতো বিবেচিত হচ্ছে। শুধু তাই নয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা বিশ্লেষণ, ক্লাউড কম্পিউটিং এবং সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে মৌলিক জ্ঞান থাকাটাও চাকরি পাওয়ার পথে বড় সুবিধা এনে দিতে পারে। এসব দক্ষতা শুধু টেক-ভিত্তিক চাকরিতেই নয়, এখন সাধারণ ব্যবসা ও সেবাখাতেও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে।
একই সঙ্গে ভাষাগত দক্ষতাও অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা। বিশ্ববাজারে কাজ করতে গেলে বা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হতে হলে শুধু ইংরেজি লিখতে জানলেই হবে না, স্বচ্ছভাবে কথা বলতেও পারতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, একজন ব্যক্তি কাজ ভালো জানলেও যোগাযোগের দুর্বলতার কারণে সুযোগ হারিয়ে ফেলছে।
আজকের দিনে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এমন কর্মী চায়, যারা শুধু নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে না, বরং নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে সমস্যা বুঝে তার সমাধান করতে পারে। সংকটময় মুহূর্তে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, দলের নেতৃত্ব নিতে পারে এবং নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। এইসব নেতৃত্বদানের ক্ষমতা আর সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এখন শুধু ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে নয়, একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের চাকরিতেও মূল্যায়িত হয়।
চাকরির প্রতি নির্ভরশীলতা একটু একটু করে কমে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এখন উদ্যোক্তা হওয়ার কথা ভাবছে। কেউ অনলাইন ভিত্তিক ছোট ব্যবসা গড়ে তুলছে, কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করছে। এজন্য প্রয়োজন আত্মনির্ভরশীল মানসিকতা, উদ্যোগ নেওয়ার সাহস এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পণ্য বা সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কৌশল।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দক্ষতাটি এখন দরকার, তা হলো মানসিক নমনীয়তা ও শেখার আগ্রহ। প্রযুক্তি ও বাজার প্রতিদিন বদলাচ্ছে, তাই একবার শিখে থেমে থাকলে চলবে না। আজ যেটা প্রাসঙ্গিক, কাল সেটাই পুরোনো হয়ে যেতে পারে। তাই নতুন কিছু শেখার মানসিকতা আর দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এখন প্রতিটি কর্মীর জন্য অপরিহার্য। এই কারণেই Google, Tesla, Amazon-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আর GPA বা সার্টিফিকেটের ওপর ভরসা করে না—তারা খোঁজে এমন লোক, যার হাতে সত্যিকারের দক্ষতা আছে।
সুতরাং বর্তমান ও ভবিষ্যতের চাকরির বাজারে সফল হতে হলে আমাদের শুধু পড়াশোনা নয়, বরং সময়োপযোগী নানা দক্ষতা আয়ত্তে আনতে হবে। “যে যত বেশি শেখে, সে তত বেশি এগিয়ে থাকে”— এই সত্যটি এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি বাস্তব।
বর্তমান সময়ে চাকরির বাজার খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। প্রযুক্তির অগ্রগতি, বিশ্বায়ন এবং কাজের ধরনে পরিবর্তনের ফলে এখন আর শুধু সার্টিফিকেটের ওপর ভরসা করে চলা যায় না। যারা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন দক্ষতা অর্জন করছে, তারাই ভবিষ্যতের বাজারে এগিয়ে থাকবে। তাই প্রয়োজন নিজের দক্ষতাগুলোকে প্রযুক্তিনির্ভর, যোগাযোগ-ভিত্তিক এবং সমস্যা সমাধানে সক্ষম করে তোলা। শুধু চাকরি খোঁজার মানসিকতা নয়, উদ্যোক্তা হওয়ার আত্মবিশ্বাসও গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি শেখা যেন কখনো থেমে না যায়—এই মনোভাব নিয়েই ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা দরকার।