বাংলাদেশের পোশাকশিল্প, যার বার্ষিক আয় প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার, দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত। তবে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক শুল্ক যুদ্ধ এবং ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে এই খাতটি নতুন এক সংকটের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার সক্রিয় ভূমিকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতির অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরোপিত অতিরিক্ত শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখলেও, সেই সময়সীমা পেরিয়ে গেলে বা শুল্ক প্রত্যাহার না হলে মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের ওপর দাম কমানোর চাপ বাড়াতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকদের লাভের পরিমাণ আরো কমে যেতে পারে।
বাংলাদেশ এখন শুধু চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার প্রতিযোগিতা নয়, বরং ভারত, পাকিস্তান, মিশর ও কেনিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও রয়েছে। ভারতের ও পাকিস্তানের মতো দেশের রপ্তানি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কহার তুলনামূলকভাবে কম যার ফলে তারা কম দামে মার্কিন বাজারে প্রবেশ করতে পারছে। এ ছাড়া মিশর ও কেনিয়াও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ অপেক্ষা কম শুল্ক দিয়ে পোশাক রপ্তানি করছে। এসব দেশ বাংলাদেশের বাজার ভাগ করে নিচ্ছে।
অন্যদিকে চীন বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রায় ১৪৫ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হলেও ইউরোপ ও জাপানে রপ্তানি বৃদ্ধির কৌশল নিচ্ছে। একই পথ অনুসরণ করছে ভিয়েতনামও। ফলে ইউরোপ ও এশিয়ার বাজারে প্রতিযোগিতা তীব্র হচ্ছে যা পণ্যের দাম কমিয়ে দিতে পারে। এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিতে বিশেষ করে মুনাফার দিক থেকে।
শুল্কবৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের দাম বেড়ে যেতে পারে। এতে ভোক্তাদের মধ্যে চাহিদা হ্রাস পাবে এবং বাজারে মন্দা দেখা দিতে পারে। এই পরিস্থিতির সরাসরি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের ওপর।
বর্তমানে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। পরিমাণগত দিক থেকে দেশটি ইতোমধ্যে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রতিবছর প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক ইউরোপে রপ্তানি করছে। তবে, চলমান বাণিজ্য দ্বন্দ্বের মধ্যে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর মূল্য হ্রাসের চাপ ইউরোপে বাংলাদেশের রপ্তানিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি পোশাকের জন্য তুলনামূলকভাবে কম দাম দিয়ে আসছে। যেমন, একটি টি-শার্টের জন্য ছয় থেকে সাত ডলার পরিশোধ করলেও চীন বা ভিয়েতনামে একই পণ্যের দাম পড়ে দশ ডলার। ফলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের অনেক সময় কম মুনাফায় পণ্য বিক্রি করতে হয়।
ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের ৩৯ শতাংশ রপ্তানিকারক বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক বজায় রাখতে উৎপাদন খরচের নিচে পণ্য বিক্রিতে রাজি হন। এতে ব্র্যান্ডগুলো বিপুল মুনাফা অর্জন করে। এক্ষেত্রে দেখা গেছে, পশ্চিমা বাজারে পাঁচ ডলারে কেনা পোশাক ২৫ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। এসব ব্র্যান্ডের স্থানীয় প্রতিনিধিরাও এই বিশাল মুনাফার কথা স্বীকার করেছেন।
বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের দরকষাকষিতে পিছিয়ে থাকার পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কাঠামোগত দুর্বলতা। সময়মতো পণ্য সরবরাহে ব্যর্থতা, অদক্ষ উৎপাদন প্রক্রিয়া, দুর্বল অবকাঠামো এবং ক্রেতাদের দামের চাপ প্রতিহত করার সক্ষমতার অভাব এই দুর্বলতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও রপ্তানিকারকদের মধ্যকার অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা বাজারকে আরো প্রতিকূল করে তুলেছে কারণ তারা একে অপরকে পেছনে ফেলতে গিয়ে মূল্য কমিয়ে দিচ্ছে।
হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, ‘বাংলাদেশের গড় শুল্কহার বর্তমানে ২৬ শতাংশ যা ভারত বা পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি।’ তার মতে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে শুল্কের প্রভাব স্পষ্ট হবে এবং ইতোমধ্যেই রপ্তানিকারকরা দামের চাপে রয়েছেন। ক্রেতারা চাচ্ছেন, বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরাই নতুন মার্কিন শুল্কের কিছু অংশ বহন করুক। এতে তাদের মুনাফা আরো কমে যাবে।
জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান জানান, ‘ক্রেতারা রপ্তানিকারকদের ১০ শতাংশ শুল্কের খরচ বহন করতে বলছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের খুচরা দাম বাড়লে বিক্রি কমে যেতে পারে যার প্রভাব পড়বে সরবরাহ ব্যবস্থায়।’
বিজিএমইএর আরেক সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘মার্কিন আমদানিকারকরা তাদের দেশে ভোক্তাদের ওপর বাড়তি খরচ চাপিয়ে না দিয়ে তা রপ্তানিকারকদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। এর ফলে দাম কমাতে বাধ্য হতে পারে বাংলাদেশ।’ তার মতে, ‘কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারেও দামে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে। ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্কও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক স্থগিতের সুবিধা ভোগ করবে।’
বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, মার্কিন শুল্ক আরোপ তিন মাস স্থগিত থাকলেও, ক্রেতারা এই অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়ে এখনই দাম কমানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিকারক এক উদ্যোক্তা বলেন, ‘বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো অনিশ্চয়তা কাজে লাগিয়ে পোশাকের দাম কমাতে কারখানাগুলোর ওপর চাপ দিচ্ছে।’
তবে, কিছু রপ্তানিকারক আশাবাদী। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক বৃদ্ধির ফলে চীন থেকে সরে যাওয়া কিছু অর্ডার বাংলাদেশে আসতে পারে। এক শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ট্রাম্প মূলত শুল্ক বাড়িয়ে চীনকে টার্গেট করেছেন। তাই বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমাদের এই সুযোগ কাজে লাগাতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে এবং দরকষাকষিতে আরও শক্তিশালী অবস্থান নিতে হবে।’
এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করে দিচ্ছে, বাংলাদেশি পোশাকশিল্প সামনে এক চ্যালেঞ্জিং সময়ের মুখোমুখি। আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে হলে শুধু মূল্য প্রতিযোগিতা নয় বরং কাঠামোগত সংস্কার, উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি এবং রপ্তানিকারকদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার কৌশল নির্ধারণ করাও জরুরি।