যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে চীন সম্প্রতি এক নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে, যেখানে তারা যুক্তরাষ্ট্রে বিরল খনিজ ও প্রাকৃতিক চুম্বক রপ্তানি না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এই সিদ্ধান্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয় বিশ্বব্যাপী শিল্প ও প্রযুক্তিখাতে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে নির্দেশ দিয়েছে, সামারিয়াম, ডোলিনিয়াম, টারবিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াম, লিউটেনিয়াম, স্ক্যানডিয়াম, ইট্রিয়ামসহ প্রায় ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ বিরল মৌল এবং চুম্বকের রপ্তানি বিশেষ অনুমতি ছাড়া বন্ধ থাকবে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ায় চীনের বন্দরগুলোতে বিপুল পরিমাণ মৌল আটকে পড়েছে। এসব উপাদান ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষ করে অ্যারোস্পেস, বৈদ্যুতিক যান, রোবোটিকস, সেমিকন্ডাক্টর এবং প্রতিরক্ষা খাতে উৎপাদন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়তে পারে।
এই বিরল মৌল ও চুম্বকগুলোর ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈদ্যুতিক মোটর থেকে শুরু করে ড্রোন, রোবট, মিসাইল ও স্পেসক্রাফ্ট সংযোজনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী চুম্বকের প্রয়োজন হয়। এর পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক কম্পিউটার সার্ভার, লাইট এমিটিং ডায়োড, ক্যাপাসিটর, চিপস ও সেন্সর তৈরিতেও এসব মৌলের বিকল্প নেই। এসব উপাদান পৃথিবীর খুব কম দেশেই পাওয়া যায় ফলে চীনের একতরফা সিদ্ধান্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশকে সংকটে ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প খাত, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা খাত এই সরবরাহ ঘাটতির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দেশটির ক্রিটিক্যাল মিনেরালস অ্যাডভাইজারি কমিটির চেয়ারম্যান ড্যানিয়েল প্ল্যাকার্ড এই সিদ্ধান্তকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখছেন।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের খনিশিল্প সংশ্লিষ্ট এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন ও রোবট হবে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। অথচ এই অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত বিরল মৌলের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি ব্যাহত হতে পারে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশে বিরল মৌলের উৎপাদন শুরু করতে উদ্যোগ নিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমি এলাকায় ইতোমধ্যে বাণিজ্যিক উৎপাদনের প্রস্তুতি চলছে।
বাণিজ্যযুদ্ধের এই পর্যায়টি শুরু হয় গত ২ এপ্রিল, যেদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি শুল্ক বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করে আর জবাবে চীনও ১২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। এই উত্তেজনার অংশ হিসেবে চীন ছয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিরল মৌলের রপ্তানি বন্ধের নির্দেশ দেয় এবং জানায়, এসব মৌল রপ্তানির জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।
উল্লেখযোগ্য যে, বিশ্বে বিরল মৌলের প্রায় ৯০ শতাংশই চীনে উৎপাদিত হয়। ফলে এই খাতে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ চীনের ওপর নির্ভরশীল। চীনের এই রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বব্যাপী উচ্চপ্রযুক্তি শিল্পে এক বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তিতে যতই অগ্রসর হোক না কেন এসব মৌলের অভাব তাদের সেই অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কীভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন এবং এই শুল্ক ও সরবরাহ সংকটের সমাধান করেন—তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রাজনীতির আগামী অধ্যায় নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে।