বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরিপোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান প্রশংসনীয় হলেও এর অগ্রযাত্রার পথে রয়েছে একাধিক অন্তরায়। অবকাঠামোগত দুর্বলতা, প্রশাসনিক জটিলতা ও অনিশ্চিত নীতিমালার মতো বড় বড় চ্যালেঞ্জ দেশটির শিল্প ও বিনিয়োগ পরিবেশকে প্রভাবিত করে চলেছে। তবুও এসব প্রতিবন্ধকতা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহে ভাটা ফেলতে পারেনি। বরং অনেকেই এখনো বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজে ফিরছেন।
তেমনই একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী জার্মানির অসপিগ জিএমবিএইচ’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টমাস কোনিং। জিনস ও ক্যাজুয়াল পোশাক উৎপাদনে খ্যাতনামা এই প্রতিষ্ঠান ১৯৯০ এর দশক থেকে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটে অংশ নিতে এসে তিনি দেশের ব্যবসায়িক বাস্তবতা, সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে মুখোমুখি হন।
আলোচনায় টমাস কোনিং স্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ থাকলেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পেতে হলে কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। তার ভাষায়, “আপনি উত্তরাঞ্চলে চমৎকার একটি কারখানা স্থাপন করতে পারেন কিন্তু যদি দক্ষতার সঙ্গে পণ্য বন্দরে পৌঁছে দিতে না পারেন তাহলে পুরো প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। অবকাঠামো উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি।”
তিনি জানান, অসপিগ বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশ ছাড়ার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। বরং সাম্প্রতিক কিছু সরকারি উদ্যোগ ও বক্তব্য তাকে আশাবাদী করেছে। বিশেষ করে ইন্ডিটেক্সের সিইও এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে তিনি ‘গভীরভাবে উৎসাহব্যঞ্জক’ হিসেবে অভিহিত করেন। টমাসের মতে, এই বার্তাগুলো শুধু আশার কথাই নয় বরং ইতিবাচক পরিবর্তন যে বাস্তবেই শুরু হয়েছে, তার ইঙ্গিত দেয়।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে উল্লেখ করে টমাস বলেন, “আমাদের যা দরকার, তা হলো স্থিতিশীলতা। আমরা তা আসতে দেখছি। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এখন খুবই ইতিবাচক।”
তবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) দ্রুত ও সহজ করতে হলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। তার মতে, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ, সহজ ও সুসংগঠিত প্রশাসনিক কাঠামো। “একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে একাধিক বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করতে গেলে পুরো প্রক্রিয়াই ধীর হয়ে যায়,” বলেন টমাস। “আমাদের দরকার সহজলভ্যতা, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা।”
অসপিগ প্রধান জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে—নীতিগত ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং দেশের মানবিক ও শিল্প সক্ষমতাকে তুলে ধরতে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
তবে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে, বিশেষ করে লজিস্টিক ও পরিকাঠামোগত সমস্যাগুলো। ঢাকার কাছে কারখানা স্থাপন করে ইউরোপে পণ্য রপ্তানি করতে হলে রপ্তানিকারকদের নির্ভর করতে হয় চট্টগ্রাম বন্দরেই। অথচ মাত্র ২৭০ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিতেই ট্রাকে সময় লাগে প্রায় দশ ঘণ্টা। পথে অন্তত ১৬টি প্রতিবন্ধকতা পেরোতে হয় বলে জানান তিনি। এই ধীর গতির সরবরাহ ব্যবস্থা বিদেশি বাণিজ্যের জন্য একটি বড় অন্তরায়।
এমন এক বাস্তবতায় টমাস মনে করেন, শুধুমাত্র পোশাক শিল্পে নয় আরো বিস্তৃত ম্যানুফ্যাকচারিং হাব গড়তে হলে বাংলাদেশকে অবকাঠামো খাতে জরুরি ভিত্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে এবং আইন প্রয়োগে কঠোরতা আনতে হবে।
তবে সব প্রতিকূলতার মাঝেও একটি বড় শক্তি হিসেবে তিনি বাংলাদেশের জনগণকে উল্লেখ করেন। “আমরা এখানে প্রায় ৩০ বছর ধরে আছি। এখানকার মানুষজনকে আমরা চিনি। তারা শেখার জন্য আগ্রহী, কঠোর পরিশ্রমী এবং অনেকেই সুশিক্ষিত। অনেক দেশে দক্ষ জনবল খুঁজে পাওয়া কঠিন কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যা ও মানসিকতা—দুটোই আছে। এটাই আপনাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ।”
অসপিগ জিএমবিএইচ বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম আরো সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে। বর্তমানে তারা স্পেন, ইতালি ও তুরস্ক থেকে যন্ত্রপাতি আমদানির খরচ মূল্যায়ন করছে। টমাস জানান, প্রতিষ্ঠানটি তৈরি পোশাক খাত ছাড়াও হাই-টেক ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে। ওয়ালটনের কারখানা পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ওয়ালটন রেফ্রিজারেটর, মোবাইল ফোন, সোলার সিস্টেমের মতো উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য তৈরি করছে। আমরা এমনকি একটি সাইকেল সংযোজন কারখানাও দেখেছি।”
তার মতে, শুধু ওষুধ শিল্পে নয় বাংলাদেশ যন্ত্রপাতি উৎপাদনেও সক্ষমতা অর্জন করছে। সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাচ্ছে নতুন নতুন খাতে।
সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষে তিনি বলেন, “আমরা প্রত্যাশা নিয়ে এই সম্মেলনে এসেছিলাম কিন্তু ফিরছি আরো বেশি দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে। বাংলাদেশ প্রস্তুত, আমরাও প্রস্তুত।”