বাংলাদেশের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শুধু সচিবালয় নয়, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়েও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সরকার চায়, সরকারি সব অফিসেই নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত হোক। এজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
প্রত্যেক সরকারি অফিসে সিসিটিভি বসানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রাতের বেলায় পাহারার ব্যবস্থাও রাখতে হবে। দরজা-জানালা ভাঙা থাকলে তা মেরামত করতে হবে। দরকার হলে নতুন করে বসাতে হবে। এই কাজে আলাদা বাজেট দরকার হলে তা কর্তৃপক্ষকে জানাতে বলা হয়েছে। সবশেষে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হলো, তা রিপোর্ট আকারে জমা দিতে হবে।
এই নির্দেশনার পেছনে রয়েছে সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনা। বিশেষ করে ২০২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগে। এরপর থেকেই নিরাপত্তা নিয়ে সরকারের নতুন চিন্তা শুরু হয়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সচিবালয়ের সামনে নানা দাবি নিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। ৮ আগস্ট আনসার সদস্যরা বিক্ষোভে অংশ নেয়। সন্ধ্যায় কিছু সদস্য সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়ে। শুরু হয় মারামারি, ইট ছোড়া আর গুলির ঘটনা।
২০ আগস্ট এইচএসসি পরীক্ষার অটোপাস চেয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। তারা সচিবালয়ের গেট ভেঙে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এরপর সরকার অটোপাসের ঘোষণা দেয়।
২৫ আগস্ট আনসারদের বড় বিক্ষোভে সচিবালয় কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অফিস শেষ হলেও অনেকেই বাইরে বের হতে পারেননি। অনেকে খালি পেটে আটকা পড়েন।
২৪ অক্টোবর শিক্ষার্থীরা আবার বিক্ষোভে নামে। ফল পুনর্মূল্যায়নের দাবি তুলে তারা সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়ে। পুলিশ ৫৪ জনকে আটক করে। পরে ২৬ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বাকিদের মুচলেকায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
এসব ঘটনার পর সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেয়। সচিবালয়ে প্রবেশের নতুন নীতিমালা তৈরি করা হয়। এখন থেকে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত হবে। নির্দিষ্ট গেটে থাকবে কার্ড রিডার আর কিউআর কোড স্ক্যানিং ব্যবস্থা। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সবাইকে বের হয়ে যেতে হবে।
কার্ডধারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তল্লাশির জন্য দেহ আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেক্টর ও ব্যাগ স্ক্যানার বসানো হবে। তাদের গাড়িও ডিজিটাল স্ক্যানিংয়ের আওতায় থাকবে। কিউআর কোডধারীরাও এই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পড়বেন।
কেউ অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র বা বিস্ফোরকসহ সচিবালয়ে ঢুকতে পারবে না। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর সরকারি অস্ত্র এই নিয়মের বাইরে থাকবে।
সরকার এআই প্রযুক্তিসম্পন্ন অত্যাধুনিক সিসিটিভি বসানোর পরিকল্পনা করেছে। এতে থাকবে মুখ চিনে ফেলার প্রযুক্তি, গাড়ির নম্বর শনাক্তকরণ, অ্যালার্ম, রাতের ছবি বিশ্লেষণসহ ১০টি সুবিধা। কোনো সন্দেহজনক ঘটনা ঘটলেই মনিটরিং রুমে তাৎক্ষণিক সতর্কতা পৌঁছাবে।
এই জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান থেকে ক্যামেরা কেনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রথম ধাপে ৬২৪টি সিসিটিভি বসানো হবে।
সরেজমিন দেখা গেছে, সচিবালয়ের পাঁচটি গেট ও আশপাশে ৭৪টি ক্যামেরা বসানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে আছে ৪৩টি ফেস ডিটেকশন ক্যামেরা, ২০টি বুলেট ক্যামেরা, ৪টি পিটিজেড ক্যামেরা ও ৭টি ফেস রিকগনাইজেশন ক্যামেরা।
২০২১ সালে ১০০ কোটি টাকায় ৭৪টি আধুনিক সিসি ক্যামেরা কেনা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে অনেক স্ক্যানার অকেজো হয়ে পড়ে। তাই নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব জানান, সচিবালয়ের চারপাশে সীমানা প্রাচীর সংস্কার করা হয়েছে। কাঁটাতারের বেড়া বসানো হয়েছে। প্রতিটি গেটে এখন কড়া নজরদারি চালু আছে। দিনরাত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সতর্কভাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সরকার বলেছে, এসব নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন থেকে নিয়মিত তদারকির আওতায় থাকবে। উদ্দেশ্য একটাই—প্রশাসনিক কাজ যেন নিরাপদে চলতে পারে।