বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম হঠাৎ করে লিটারে ১৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ১২ টাকা করে। পণ্যগুলোর ওপর করছাড় প্রত্যাহার করার পর গতকাল মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি দেখা গেছে, কয়েক দিনের ব্যবধানে বাজারে পেঁয়াজ, ডিম ও সবজির দামও বেড়েছে। এছাড়া কিছুটা বেড়েছে আটার দাম। চাল ও ডালের দাম অনেক আগে থেকেই বেশি এখনো তাতে কমার কোনো ইঙ্গিত নেই।এ অবস্থায় গত রোববার থেকে নতুন কারখানা ও অনুমোদিত সীমার অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ হারে মূল্যবৃদ্ধি করেছে সরকার।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত শিল্পখাতে অনুমোদিত লোডের চেয়ে অতিরিক্ত ১৪ কোটি ৭৮ লাখ ঘনমিটার এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে অতিরিক্ত ৫ কোটি ৭৬ লাখ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহৃত হয়েছে। এই অতিরিক্ত গ্যাসের মূল্য এখন নতুন দরে পরিশোধ করতে হবে যা পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়াবে বলেই ধারণা।
এই করছাড় প্রত্যাহার, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এমন এক সময় ঘটল যখন সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় রয়েছে। তবুও মার্চ মাসেও মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে থেকে গেছে।
সয়াবিন তেলের দাম এভাবে একধাক্কায় বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই সরকারের এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি তুলেছেন। “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন” নামের একটি ফেসবুক পেজে বলা হয়, সরকার যত অজুহাতই দিক না কেন এই মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। ফায়েজ আহমেদ নামে একজন লিখেছেন, “দাম কমান। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেন। এমনিতেই সয়াবিন তেলের দাম সাধ্যের বাইরে।”
বর্তমানে এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের নতুন মূল্য ১৮৯ টাকা, যা আগে ছিল ১৭৫ টাকা। পাঁচ লিটারের বোতলের দাম ৯২২ টাকা থেকে বেড়ে ৯৫২ টাকা হয়েছে। খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৯ টাকা প্রতি লিটার যা আগে ছিল ১৫৭ টাকা।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পর এই নতুন দাম ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ১৩ এপ্রিল থেকেই নতুন দাম কার্যকর হয়েছে।
এর আগে ২০২৩ সালের ৯ ডিসেম্বর সর্বশেষ একবার সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল, তখন বেড়েছিল ৮ টাকা। তবে পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে ব্যবসায়ীরা আবারও দাম বাড়াতে চেয়েছিলেন। সে সময় সরকার শুল্ক-কর ছাড় দিয়ে দাম বাড়ানো ঠেকিয়েছিল। ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর সরকার ভোজ্যতেলে মূসক ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করে পরবর্তী মাসে তা আরও কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে।
তেলকল মালিকদের সংগঠন জানিয়েছে, ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ ৩১ মার্চ শেষ হয়ে যাওয়ায় এক লিটার সয়াবিন তেলের মূল্য ১৯৮ টাকা হওয়া স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ভোক্তাদের স্বার্থ বিবেচনায় সেটি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮৯ টাকা।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, সরকার রমজান পর্যন্ত প্রতি মাসে প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা রাজস্ব ছাড় দিয়েছে, যা কয়েক মাসে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। কিন্তু এই ব্যয় বহন করা সরকারের পক্ষে এখন কঠিন। তিনি বলেন, “এই মূল্যবৃদ্ধি সাময়িক। ভবিষ্যতে দাম আবার কমানো সম্ভব হবে।” তবে এ মুহূর্তে ভ্যাট ছাড় দেওয়া সরকারের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে বাজারে আবারও বাড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম। রমজানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৪০ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকায়। পাবনার উৎপাদিত পেঁয়াজের দাম আরও বেশি—৫৫ থেকে ৬০ টাকা। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানিয়েছে, পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা। যদিও চলতি মৌসুমে ভালো উৎপাদন হয়েছে, তবে এখন সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে বলে দাবি বিক্রেতাদের।
ঈদুল ফিতরের পর ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির চাহিদা কমায় দাম কিছুটা কমেছে। এখন ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায়, সোনালি মুরগি ২২০ থেকে ২৬০ টাকায়। তবে ডিমের দাম বেড়েছে। ফার্মের বাদামি ডিমের ডজন পাওয়া যাচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়, যা আগের তুলনায় ডজনে ১০ টাকা বেশি।
চালের দাম দীর্ঘদিন ধরেই চড়া থাকলেও নতুন করে বাড়েনি। তবে খোলা আটার কেজিপ্রতি দাম ২ টাকা বেড়েছে বলে জানিয়েছে টিসিবি। ডাল ও চিনির দাম এখনো আগের মতোই বেশি—চিনির বর্তমান দাম কেজিতে ১২০ টাকার আশপাশে।
সবজির বাজারেও মূল্যবৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। শীতকালীন সবজি সরবরাহ শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন গ্রীষ্মকালীন নতুন সবজি বাজারে এসেছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে সাতটি সবজির দাম বেড়েছে—যথা কাঁচা পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া, চিচিঙ্গা, দেশি টমেটো, লাউ, চালকুমড়া ও দেশি গাজর। এসব সবজির দাম ১৪ থেকে ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কাঁচা পেঁপের যৌক্তিক দর ২৩ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়। রাজধানীর বাজারে বেশিরভাগ সবজি কেজিতে ৫০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সরকার নিত্যপণ্য আমদানিতে সাধারণত শুল্কছাড় দিয়ে থাকে। গম, ডাল, পেঁয়াজ ও রসুনের মতো পণ্যে প্রায়ই ছাড় দেওয়া হয়। তবে নিয়মিত আমদানি হওয়া ভোজ্যতেল, চিনি, গুঁড়া দুধ, মসলা ও ফলে তুলনামূলকভাবে উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়। যদিও ভোজ্যতেলে শুল্ক-কর অন্যান্য পণ্যের তুলনায় কম।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়েছে, ২০২৪ সালে শুধু সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ২ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। আর চিনির মাধ্যমে বছরে ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আসে।
এই প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “সরকারের এখন মূল লক্ষ্য রাজস্ব বাড়ানো ও ভর্তুকি কমানো। কারণ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের পরবর্তী কিস্তি পেতে হলে এই দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে।”
তবে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও দেখা যাচ্ছে। রাতে এক বিবৃতিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। হঠাৎ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে তাদের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। এনসিপি মনে করে, ব্যবসায়ীদের একতরফা দাবিতে নয় বরং ভোক্তা সংগঠন ও শ্রমজীবী জনগণের মতামতের ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ করাই হবে সবচেয়ে ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য পন্থা।