বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক পূর্বাভাসে উদ্বেগ বাড়ছে ঢাকাসহ দেশের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। সংস্থাটি জানিয়েছে, আগামী ৩০ জুন ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াতে পারে মাত্র ৩.৩ শতাংশে, যা গত ৩৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ মাত্র চার মাস আগেই, জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাংক ৪.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করেছিল। বিনিয়োগ হ্রাস, স্থায়ী উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সেই আশাবাদ ম্লান হয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের ‘ম্যাক্রো পোভার্টি আউটলুক’ শিরোনামে প্রকাশিত এ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়তে পারেন যাদের দৈনিক আয় ২.১৫ ডলারের নিচে। প্রতিবেদনে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থানের হ্রাস বিশেষ করে নিম্নআয়ের পরিবারের জন্য বড় ধাক্কা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেই প্রায় ৪ শতাংশ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন এবং স্বল্পদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি কমেছে ২ শতাংশ উচ্চদক্ষদের ক্ষেত্রে তা ০.৫ শতাংশ।
এই পরিস্থিতিতে চরম দারিদ্র্যের হার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৭.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৯.৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর ফলে ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের চক্রে পড়ে যেতে পারেন। বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, আয় বৈষম্যও বাড়বে। জিনি সূচক অনুযায়ী, প্রায় ১ পয়েন্ট বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে যেসব পরিবার প্রবাসী আয় পান তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি থাকতে পারে। পাশাপাশি ৫টির মধ্যে ৩টি পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে খরচ চালাতে বাধ্য হচ্ছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, জিনি সূচক (বা সহগ) হলো বৈষম্য পরিমাপের একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি। এর স্কেল শূন্য থেকে এক পর্যন্ত। শূন্য মানে সম্পূর্ণ আয় সমতা এক মানে সম্পূর্ণ অসাম্য। সূচক যত বাড়ে, সমাজে আয়-বৈষম্য তত বেশি।
বিশ্বব্যাংক তার প্রতিবেদনে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতির অনিশ্চয়তা, সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে ব্যর্থতা, চলমান মুদ্রাস্ফীতি, মৌসুমি জ্বালানি সংকট ও ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা—সবকিছু মিলিয়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে আরও পিছিয়ে দিতে পারে বলে সতর্ক করেছে। যদিও কিছু বাহ্যিক চাপ কিছুটা কমেছে যেমন ভারসাম্যহীন পেমেন্ট ঘাটতির হ্রাস এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্থিতিশীলতা এসেছে।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বিশ্বব্যাংকের এই চিত্র আসলে দেশের বাস্তবতাই তুলে ধরেছে।” তিনি মনে করেন, সামষ্টিক অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতার পাশাপাশি সরকারের নীতিনির্ধারকরা যে তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করছেন, সেটিও এই পূর্বাভাসে প্রভাব ফেলেছে।
তবে অধ্যাপক মুস্তাফিজুর উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে সবচেয়ে ক্ষতিকর উপাদান হিসেবে দেখছেন। তার মতে, এটি বিশেষ করে নিম্ন আয়ের ও আর্থিকভাবে দুর্বল জনগণের ক্রয়ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তিনি বলেন, “দুই দিন কাজ না পেলে প্রায় ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যেতে পারে।” এজন্য তিনি মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার ওপর জোর দিয়ে বলেন, “এক্ষেত্রে রাজস্ব ও আর্থিক নীতির আরও কার্যকর প্রয়োগ দরকার।”
তিনি বর্তমান ১০ শতাংশ নীতি সুদের হার (Policy Rate) কমানোর সুযোগ দেখছেন না, যতক্ষণ না মূল্যস্ফীতি স্পষ্টভাবে হ্রাস পায়। বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে এবং প্রবৃদ্ধি বাড়াতে শুধু প্রণোদনা নয়, ব্যবসার ব্যয় কমানো, পরিবহন ও লজিস্টিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগে অধ্যাপক মুস্তাফিজুর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা এবং লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তার মতে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে যেন প্রকৃত দরিদ্র মানুষ উপকৃত হন।
অবশ্য এই হতাশাজনক পূর্বাভাসের মধ্যেও বিশ্বব্যাংক কিছু আশাবাদের ইঙ্গিত দিয়েছে। তাদের মতে, কাঠামোগত কিছু সংস্কার বাস্তবায়িত হলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৪.৯ শতাংশে উন্নীত হতে পারে এবং মূল্যস্ফীতি কমে ৭.৭ শতাংশে নামতে পারে।
তবে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার তুলনায় বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস বেশি হতাশাব্যঞ্জক। আইএমএফ আগামী অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৫.২ শতাংশে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। একইভাবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৫.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস দিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ওপরও। বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ৫.৮ শতাংশে নেমে আসবে যা পূর্বের তুলনায় ০.৪ শতাংশ পয়েন্ট কম। তবে ২০২৬ সালে এই প্রবৃদ্ধি ৬.১ শতাংশে উন্নীত হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার বলেন, “গত দশকের একাধিক অভিঘাত দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর আর্থিক সহনশীলতা দুর্বল করে দিয়েছে। এখনই সময় কাঠামোগত সংস্কার জোরদার করা, বাণিজ্য উন্মুক্ত করা, কৃষি আধুনিকীকরণ এবং বেসরকারি খাতকে গতিশীল করার।”
বিশ্বব্যাংকের এই পূর্বাভাস অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর কঠিন বাস্তবতা সামনে এনেছে। এর প্রতিকারে কার্যকর সংস্কার এবং দৃঢ় নীতিকৌশলই হতে পারে একমাত্র পথ।