কিছু বছর আগেও বাংলাদেশে কফি ছিল একটি বিলাসবহুল পানীয় যা অভিজাত শ্রেণির জীবনের অংশ হিসেবে দেখা হতো। তখন চা ছিল মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের পানীয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট বদলেছে। এখন কফি প্রবেশ করেছে সীমিত আয়ের মানুষের ঘরেও। তবু এটি এখনো শহুরে আধুনিক জীবনের প্রতীক হয়ে আছে।
আজকের নগরজীবনে কফি শুধুমাত্র একটি পানীয় নয় এটি হয়ে উঠেছে আড্ডা, সৃজনশীলতা এবং ভিনদেশি সংস্কৃতি গ্রহণের মাধ্যম। বিশেষ করে শহরের পাড়া-মহল্লায় গড়ে ওঠা ছোট ছোট কফিশপে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেশি লক্ষ্য করা যায়। সেখানে শুধু কফি পান নয়, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, নতুন বন্ধু তৈরি এবং স্বল্প পরিচিতদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার ক্ষেত্র হিসেবে এই স্থানগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, গত দেড় দশকে তরুণ প্রজন্মের রুচি ও পছন্দে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসার, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এবং উন্নত বিশ্বে কফি সংস্কৃতির অনুসরণ এইসব মিলিয়ে ঢাকার আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের কফিশপ। ক্রমে দেশে তৈরি হচ্ছে একধরনের ‘কফি কালচার’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপদ এবং সৃজনশীল পরিবেশের অভাবে তরুণরা নির্ভর করছে কফিশপের ওপর। ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে প্রতিটি দোকানেই আনতে হচ্ছে বৈচিত্র্য ও রুচির ছোঁয়া। মূলত ২০১০ সালের পর থেকেই এই সংস্কৃতির বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। ধানমন্ডি, বনানী, উত্তরা ও মিরপুরের মতো এলাকাগুলোতে এখন ট্রেন্ডি ক্যাফের ছড়াছড়ি।
২০০০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে কফি ওয়ার্ল্ড ছিল রাজধানীর হাতে গোনা কয়েকটি মানসম্পন্ন কফিশপের একটি। পরবর্তী সময়ে অনেক চায়ের দোকান রূপান্তরিত হয়েছে কফিশপে। তরুণ পেশাজীবী ও শিক্ষার্থীরা এখানে ল্যাপটপ খুলে কাজ করছেন, কেউবা একা সময় কাটাচ্ছেন। এসব দোকান শান্ত পরিবেশ, ফ্রি ওয়াইফাই এবং প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সুবিধা দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করছে।
২০১১ সালে নর্থ এন্ড কফি রোস্টারস নামের একটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ঢাকায় যাত্রা শুরু করে এবং দ্রুতই ভালো কফির প্রসারে একটি অগ্রগামী শক্তি হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর গ্লোরিয়া জিন্স, ক্রিমসন কাপের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোও বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে।
২০১৪ সালে রাজধানীর উত্তরায় যাত্রা শুরু করে দেশি প্রতিষ্ঠান ‘বিনস অ্যান্ড অ্যারোমা কফিস’। বর্তমানে তাদের ঢাকায় তিনটি শাখা রয়েছে এবং একটি নির্মাণাধীন রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তারিকুল ইসলাম মনে করেন, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে অনেক ছোট কফিশপ চালু হওয়ায় ভালো মানের কফি প্রস্তুতকারক ও দক্ষ জনবল তৈরি হয়েছে যা পুরো খাতের জন্য ছিল এক ধরনের টার্নিং পয়েন্ট। একই সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে ক্যাফেগুলোর চিত্তাকর্ষক বিপণন তরুণদের ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছে।
তার মতে, কফি এখন শুধুমাত্র পানীয় নয় বরং একটি জীবনধারা। তরুণ উদ্যোক্তারা ফ্র্যাঞ্চাইজির উপর নির্ভর না করে নিজেরা ব্র্যান্ড তৈরি করছেন এবং নিজের মতো করে তা গ্রাহকের কাছে তুলে ধরছেন। তবে ভালো মানের কফি বিনের আমদানিতে উচ্চ শুল্ক বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে আছে। পাশাপাশি দোকান ভাড়ার উচ্চ ব্যয় এবং দক্ষ বারিস্তার অভাবও বড় চ্যালেঞ্জ।
সাধারণত ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা কফিশপে বেশি আসেন। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত, শহুরে আধুনিক জীবনধারায় অভ্যস্ত এবং সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় তরুণরা নিয়মিত এই জায়গাগুলোতে আসেন। ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন কফি সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী এবং কক্সবাজারের মতো শহরেও। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক এলাকায় এর প্রসার আরও বেশি।
কফি ওয়ার্ল্ডের এরিয়া ম্যানেজার জুয়েল দাস জানান, ২০০৫ সালে বনানীতে প্রথম আন্তর্জাতিক কফি চেইন হিসেবে তারা বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে। তিন মাসের মধ্যে আরও চারটি আউটলেট চালু হয় এবং বর্তমানে দুটি নতুন শাখা চালুর পরিকল্পনা চলছে। তার ভাষায়, ‘শুরুর সময় কেবল ২০ শতাংশ মানুষ কফি চিনত এখন তা বেড়ে ৭০ শতাংশে পৌঁছেছে।’ বর্তমানে দেশে কিছু পরিমাণ কফি উৎপাদন হলেও আমদানির উপর নির্ভরতা এখনো বেশ প্রকট।
অ্যাওয়েক ক্যাফে অ্যান্ড বিস্ট্রোর সহকারী ব্যবস্থাপক অমিত কস্তা বলেন, ২০২৩ সালে রাজধানীর গ্রাহকদের মানসম্পন্ন কফি ও পরিবেশ দিতে তারা ব্যবসায় নামেন। বর্তমানে বসুন্ধরায় একটি শাখা চালু রয়েছে এবং আরও একটি নির্মাণাধীন। দোকান, প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম ও সরবরাহ ব্যবস্থায় তাদের বিনিয়োগ প্রায় আট কোটি টাকা। তাদের গ্রাহকদের মধ্যে তরুণ পেশাজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ফ্রিল্যান্সার, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের আধিক্য রয়েছে।
ম্যাকলারেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহনাফ সাঈদের মতে, আগে এক কাপ কফিতে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ করা কঠিন ছিল মানুষের কাছে। এখন সেটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তার প্রতিষ্ঠান ২০২৪ সালে যাত্রা শুরু করে, যার দৈনিক বিক্রি এখন ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে। আগামী সেপ্টেম্বরে মতিঝিলে দ্বিতীয় শাখা খোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি বলেন, “আমরা এখন এমন এলাকাগুলোতে যেতে চাই যেখানে এখনো কফিশপের সংখ্যা কম।”
বর্তমানে শহরের অনেক ছোট দোকানে চায়ের পাশাপাশি কফিও পরিবেশন করা হচ্ছে। এতে করে চা পছন্দ করা মানুষজনের মধ্যেও কফির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাফিউল ইসলাম জানান, ক্লাসের বিরতিতে বা পড়ালেখার পর ক্লান্তি দূর করতে তিনি প্রায়ই কফিশপে যান। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্টের কাজ কিংবা একা সময় কাটানোর জন্যও এটি আরামদায়ক জায়গা।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী শারমিন আক্তার বলেন, ‘কাজের প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে কফিশপে যাই। কাস্টমারের সঙ্গে আলোচনা করতে শান্ত পরিবেশ দরকার হয় যা কফিশপে পাওয়া যায়।’
ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স পরিচালক শামীমা আক্তার বলেন, এখন অফিস শুধু চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কফিশপগুলো শিক্ষার্থী, পেশাজীবী কিংবা সৃষ্টিশীল মানুষদের জন্য হয়ে উঠেছে অনানুষ্ঠানিক সামাজিক কেন্দ্র। এ পরিবর্তন নজরে এসেছে বড় বড় কর্পোরেট হাউজগুলোরও যারা বাজার সম্প্রসারণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে কফি সংস্কৃতির এই দ্রুত বিকাশের পেছনে রয়েছে তরুণদের নেতৃত্ব। ১৯৯৮ সালে দেশে প্রথমবার কফি বাজারজাত করে নেসলে। এখন তাদের পাশাপাশি আরও কিছু ছোট প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে কফি আমদানি ও বিপণন করছে।
সরকারি তথ্য বলছে, গত ১০ বছরে চায়ের বাজার যেখানে বছরে পাঁচ শতাংশ হারে বাড়ছে, সেখানে কফির বাজার বেড়েছে ৫৬ শতাংশ হারে। ২০১২ সালে দেশে কফি আমদানি হয়েছিল ২৬৪ টন যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৭৪৫ টনে। অন্যভাবে বললে, চায়ের তুলনায় কফির চাহিদা ১১ গুণ দ্রুত বাড়ছে। যদিও এখনো ৯০ শতাংশ পরিবারের চা পান করার প্রবণতা থাকলেও কফি খায় মাত্র ১৫ শতাংশ পরিবার।
বর্তমানে বাংলাদেশ কফি আমদানি করছে প্রায় ৪০টি দেশ থেকে। এর মধ্যে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল ও ভিয়েতনাম থেকেই আসে মোট আমদানির ৮৮ শতাংশ।
এই সবকিছুর সমন্বয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের শহুরে জীবনধারায় কফি এখন কেবল পানীয় নয় বরং একটি সংস্কৃতি। তরুণদের হাত ধরে এই পরিবর্তন ছড়িয়ে পড়ছে বড় শহর ছাড়িয়ে ছোট শহরগুলোতেও, তৈরি করছে এক নতুন কফি-নির্ভর সামাজিক যোগাযোগের পরিসর।