বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ( FDI- Foreign Direct Investment ) আজকের বৈশ্বিক অর্থনীতির এক অনিবার্য অনুষঙ্গ। উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালার মাধ্যমে বৈদেশিক মূলধন আকর্ষণে সচেষ্ট। দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পোন্নয়ন, কর্মসংস্থান, অবকাঠামোগত বিকাশ এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে FDI গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে গত এক দশকে কিছু সাফল্যের পরেও সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক বিনিয়োগের ধারা ক্রমশ: দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠে—বিদেশি বিনিয়োগে বাংলাদেশ বর্তমানে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, কী কারণে সংকট, এবং কোন পথে অগ্রগতি সম্ভব?
বাংলাদেশে FDI এর একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও প্রবণতা: বাংলাদেশে FDI প্রবাহ শুরু হয় ১৯৮০-এর দশকে Structural Adjustment Program (SAP) গ্রহণের মাধ্যমে। এরপর ১৯৯০-এর দশকে বিনিয়োগবান্ধব আইন ও বেসরকারিকরণ নীতির আওতায় বৈদেশিক বিনিয়োগের পথ উন্মুক্ত হয়। ২০১০ সালের পর পোশাকশিল্প, টেলিযোগাযোগ ও বিদ্যুৎখাতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ প্রবাহ দেখা যায়।
তবে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বেশ হতাশাজনক।২০২৩ সালে নিট বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালের তুলনায় ১৪% হ্রাস।২০২৪ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে FDI নেমে এসেছে মাত্র ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারে, যা গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে নিট বৈদেশিক বিনিয়োগ দাঁড়ায় প্রায় ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে। এটি প্রমাণ করে যে, সাম্প্রতিক সময়ের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস করেছে।
FDI-এর খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ: নিম্ন লিখিত খাতগুলোতে FDI-এর প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেশের বিনিয়োগ চিত্র স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে।
তৈরি পোশাক (RMG) ও টেক্সটাইল: এই খাতটি দীর্ঘদিন ধরেই বিনিয়োগে শীর্ষে। সস্তা শ্রম, বড় রপ্তানি বাজার এবং স্থাপিত অবকাঠামোর কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী। তবে বেশ কিছু সমস্যাও রয়েছে। যেমন: শ্রম আইনের জটিলতা, শ্রমিক অসন্তোষ এবং নিম্ন প্রযুক্তি নির্ভরতা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি: বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে যেমন: সুমিট গ্রুপ, চায়না হার্বিন ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাক্সিয়াটা (রবি) ইত্যাদি কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে। তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন: বিলম্বিত পেমেন্ট, পাওনা নিষ্পত্তিতে বিড়ম্বনা এবং রিজার্ভ ঘাটতির কারণে আমদানি বিল পরিশোধে জটিলতা
তথ্যপ্রযুক্তি খাত (ICT): বেশ কয়েকটি সফটওয়্যার কোম্পানি ও ডেটা সেন্টার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে। তবে ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং ও স্টার্টআপ বিনিয়োগ এখনও অত্যন্ত সীমিত।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি: বিশ্বব্যাপী ক্লিন এনার্জি ফোকাস বাড়লেও বাংলাদেশে এখনও এই খাতে বৃহৎ বিনিয়োগ আশানুরূপ নয়। SECI, JERA, Summit Power-এর কিছু প্রচেষ্টা থাকলেও নীতিগত অনিশ্চয়তা বিনিয়োগে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগে প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ হলো নিম্নরূপঃরাজনৈতিক ও নীতিগত অনিশ্চয়তা: সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরিয়েছে। এছাড়া হঠাৎ করে নীতির পরিবর্তন বা নতুন শুল্ক আরোপ বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্তকে ব্যাহত করে।
বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট: টাকার মান ২০২২ থেকে ২০২৪ এর মধ্যে ৩৫% কমেছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা মূলধন ফিরিয়ে আনতে বা রিটার্ন আদায়ে সমস্যায় পড়ছেন।
অবকাঠামোগত দুর্বলতা: চট্টগ্রাম বন্দরের অদক্ষতা, পণ্য পরিবহনে দীর্ঘসূত্রতা এবং বিদ্যুৎ সরবরাহে অনিশ্চয়তা এসব কারণে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতি: BIDA-এর ওয়ান স্টপ সার্ভিস এখনও পুরোপুরি কার্যকর নয়। তাছাড়া অনুমোদনের দীর্ঘ সময়, দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে।
উচ্চ করহার ও দ্বৈত করনীতি: বাংলাদেশে করহার (৩০%) দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম উচ্চ। এছাড়া অনেক দেশীয় বিনিয়োগ সুবিধা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পান না।
বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থান: World Bank-এর Doing Business রিপোর্টে বাংলাদেশ ২০১৯ সালে ছিল ১৬৮তম অবস্থানে। যদিও ২০২০ সালে কিছু সংস্কার হয় কিন্তু ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া বা ফিলিপাইনস-এর তুলনায় এখনও অনেক পিছিয়ে। বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীরা এখন FDI এর জন্য যে বিষয়গুলো বিবেচনা করে— যেমন: Ease of Doing Business, নীতিগত স্বচ্ছতা, বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা— তাতে বাংলাদেশের স্কোর দুর্বল।
সম্ভাবনা ও সুযোগ: যদিও চ্যালেঞ্জ রয়েছে তবে নিচের খাতগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগের বড় সুযোগ রয়েছে-
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ):BEZA-এর অধীনে ১০০+ SEZ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে জাপানি অঞ্চল (নারায়ণগঞ্জ),
চায়নিজ অঞ্চল (চট্টগ্রাম) এবং মোংলা ইকোনমিক জোন— বহু বিদেশি কোম্পানির আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
ওষুধ ও বায়োটেক: বাংলাদেশ এখন ৯৮% ওষুধ নিজেরাই উৎপাদন করে এবং ১৫০টি দেশে রপ্তানি করে। বিদেশি কোম্পানির জন্য যৌথ উদ্যোগের বিশাল সুযোগ রয়েছে।
ডিজিটাল ইকোনমি: বাংলাদেশে ১৮ কোটির বেশি মোবাইল ব্যবহারকারী এবং ১২ কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে। ই-কমার্স, ফিনটেক, AI ও ডেটা বিশ্লেষণে বিদেশি কোম্পানির আগ্রহ বাড়ছে।
বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প: পদ্মা সেতু, রূপপুর প্রকল্প, ঢাকা মেট্রো, কর্ণফুলী টানেল—সবই ভবিষ্যতের নতুন বিনিয়োগ ক্ষেত্র সৃষ্টি করছে।
সরকারি উদ্যোগ ও নীতিমালা: BIDA ‘One Stop Service’ চালু করেছে (তবে এখনও অকার্যকর)। BEZA ৩৯টি SEZ অনুমোদন দিয়েছে। Bangladesh Investment Climate Fund (BICF) বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় নিয়ন্ত্রক সংস্কারে সহায়তা দিচ্ছে। ১৯টি খাতে FDI Heatmap চালু করেছে—যা বিনিয়োগ নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করছে।
ভবিষ্যৎ করণীয় ও নীতিগত সুপারিশ: রাজনৈতিক ও নীতিগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। কর কাঠামো সংস্কার করে করহার হ্রাস করা। বিনিয়োগ অনুমোদনের সময়সীমা নির্ধারণ ও এক স্টপ সার্ভিস বাস্তবায়ন। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পণ্য পরিবহনে গ্যারান্টেড সার্ভিস। শ্রম আইন ও শ্রমিক নিরাপত্তা উন্নয়ন। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মুনাফা ফেরত পাঠাতে সহায়তা বৃদ্ধি। উচ্চ শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তোলা এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন সুবিধা রাখা
বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল—ভারত, চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাঝখানে অবস্থিত হওয়ায় এই দেশের অবস্থান কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিপূর্ণ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন কাঠামোগত সমস্যা, নীতিগত অনিশ্চয়তা ও দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশ সেই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না। যদি সুশাসন, অবকাঠামো এবং নীতিমালায় স্থিতিশীলতা আনা যায়, তবে আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম FDI গন্তব্যে পরিণত হতে পারবে। এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ বাস্তবায়ন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিনিয়োগ পরিবেশ গড়ে তোলা।

