গ্রিসের ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে অনেক গল্প আছে। কেউ বলেন, এটি একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের সাফল্যের গল্প। কেউ বলেন, অলস ছাত্র থেকে ক্লাসের সেরা হয়ে ওঠার উদাহরণ। কিন্তু এই লেখার উদ্দেশ্য গ্রিসকে প্রশংসা করা নয়। বরং ইউরোপের অন্যান্য দেশের নাগরিকদের সতর্ক করা—তারা যেন এই ‘সাফল্যের গল্প’ দেখে বিভ্রান্ত না হন। কারণ সেই পথেই লুকিয়ে আছে বিপদের সম্ভাবনা।
আজ গ্রিস অর্থলগ্নিকারীদের জন্য এক নতুন ‘এল দোরাদো’—স্বর্ণখনি। তারা এখানে আসে, বিপর্যস্ত বন্ধকি সম্পত্তি কিনে মাত্র ৫ শতাংশ দামে। সেই অ্যাপার্টমেন্টে থাকা পরিবারকে উচ্ছেদ করে তা ৫০ শতাংশ দামে বিক্রি করে ১০ গুণ লাভ তোলে। এরপর সেই লাভের একাংশ তারা গ্রিক সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করে এবং ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের (ইসিবি) সমর্থনের কারণে নিরাপদ মুনাফা পায়।
শুধু বিনিয়োগকারীরাই নয়, বড় বড় করপোরেশনও গ্রিসে ছুটে এসেছে। গ্রিক করদাতার অর্থে পুনঃপুঁজিকৃত ব্যাংক ঋণ নিয়ে, একটি জার্মান রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ১৪টি লাভজনক বিমানবন্দর কিনে নেয়। ইউরোপীয় ফান্ড দিয়ে সেগুলো সংস্কার করে এবং এখন মুনাফা পাঠাচ্ছে জার্মানিতে—লুক্সেমবার্গ হয়ে।
এদিকে, গ্রিসে আবার এক নতুন ঋণ-নির্ভর প্রবৃদ্ধির বুদ্বুদ তৈরি হচ্ছে। দেশটি আবার সেই পুরনো ফাঁদে পড়ছে, যেখানে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে নতুন কোনো মূল্য তৈরি হচ্ছে না। পশ্চিমা মিডিয়া আবার উৎসবে মাতছে।
তবে এই সফলতার গল্পের আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ বাস্তবতা। আজও গ্রিক নাগরিকদের প্রকৃত আয় ২০০৯ সালের তুলনায় ৪১ শতাংশ কম। প্রকৃত মজুরি কমেছে ৩০ শতাংশ। রাষ্ট্রের কাছে জনগণের বকেয়া এখন জিডিপির ৪৯.২ শতাংশ, যা ২০০৯ সালে ছিল ২১.৫ শতাংশ। বেসরকারীকরণের পর বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৮৫ শতাংশ, ভাড়া বেড়েছে ৯৩ শতাংশ।
জনসংখ্যা সংকটও বাড়ছে। ২০০৯ সালে গ্রিসে নবজাতকের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার। ২০২৪ সালে তা নেমেছে ৬৩ হাজারে। মিডিয়ার স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও গ্রিস পিছিয়েছে। ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’ এর সূচকে গ্রিস পিছিয়েছে ৫৩ ধাপ।
তবে এই সব দুঃসংবাদকে বিনিয়োগকারীরা ‘গোলমাল’ বলেই এড়িয়ে যায়। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে লাভ।
এ কারণে এই লেখাটি শুধু গ্রিস নিয়ে নয়। এটি সতর্কবার্তা জার্মানদের জন্য।
১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়ার পর আর্থিক বাজারগুলো গ্রিসে অনুৎপাদনশীল ঋণভিত্তিক প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন করেছিল। তখন গ্রিস শিল্পবিলোপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপীয় গণমাধ্যম গ্রিসকে সফলতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে মার্কিন মর্টগেজ সংকটের পর সব কিছু মুখ থুবড়ে পড়ে।
আজ জার্মানিও একধরনের শিল্পবিলোপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিগত এক দশকে সেখানে উৎপাদনশীল খাতে খুব কম বিনিয়োগ হয়েছে। এখন তাদের বাজেট ব্যালান্স করতে ৮৫০ বিলিয়ন ইউরো ঋণ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, যা জিডিপির ২০ শতাংশের সমান।
এই টাকা যাবে অস্ত্র, পুরনো রেলপথ সংস্কার এবং অন্যান্য অনুৎপাদনশীল খাতে। অথচ এই বিনিয়োগ থেকে টেকসই আয় আসবে না।
২০০০-এর দশকে গ্রিস যেমন ইইউ ও রেটিং এজেন্সিকে ভুল বুঝিয়ে ঋণ নিয়েছিল, আজ জার্মানিও একই পথ নিচ্ছে। পূর্বাভাস বলছে, প্রবৃদ্ধি বাড়বে। তবে সেই পূর্বাভাস নির্ভর করছে নতুন ঋণ অনুমোদনের ওপর।
তারা কি জানে না কী হতে যাচ্ছে? তারা কি গ্রিসের ইতিহাস ভুলে গেছে? তারা কি বুঝতে পারছে না যে অতিরিক্ত ব্যয় ভবিষ্যতের জন্য বিপদ ডেকে আনবে?
হয়তো জার্মানি গ্রিসের মতো আরেকটি বৈশ্বিক সংকটের কবলে পড়বে না। কিন্তু যদি পড়ে, তবে সেটি হবে অনেক বড় বিপর্যয়। তখন তারা পরিণত হবে নতুন ‘এল দোরাদো’তে—বিনিয়োগকারীদের জন্য।
সেই সময়ও জনসাধারণ চাপে থাকবে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সংকোচন আর অপমানের মধ্যে দিয়ে যাবে সাধারণ মানুষ। আর অর্থলোভীরা উদযাপন করবে ‘নতুন সাফল্যের গল্প’।
ইয়ানিস ভারুফাকিস: গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং মিরা টোয়েন্টি ফাইভ দলের নেতা। এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক।

