ভারত ও চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন আমদানি শুল্ক কার্যকর হওয়ার পর মার্কিন ক্রেতারা বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করেছেন। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশি পোশাক শিল্প আবারও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনায় এসেছে। শুধু গত দুই সপ্তাহেই কয়েকটি বড় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বাংলাদেশে অতিরিক্ত অর্ডারের প্রস্তাব দিয়েছে, যা মূলত ভারত ও চীনের সরবরাহ স্থানান্তরের ফল।
শুধু মার্কিন ক্রেতারাই নয়, ভারতের বড় রপ্তানিকারকরাও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে বাংলাদেশের শীর্ষ পোশাক কারখানার সঙ্গে অংশীদারিত্বে আগ্রহ দেখাচ্ছে। চীনা বিনিয়োগকারীরাও সরাসরি কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, চট্টগ্রামের মিরসরাই বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইতোমধ্যেই দুইটি প্রতিষ্ঠান কারখানা স্থাপনের চুক্তি সম্পন্ন করেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় পোশাক সরবরাহকারী দেশ। ভিয়েতনাম, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও কোরিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি বাংলাদেশের পোশাকের শুল্ক হার ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছেন, যেখানে চীনা পণ্যে শুল্ক ৩০ শতাংশ এবং ভারতীয় পণ্যে ২৫ শতাংশ। এছাড়া রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি নিয়ে ভারতে ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আগামী ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সব উৎপাদক দেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। এখন দেখার বিষয়, ভোক্তারা কতটা সহজে শুল্কের প্রভাব মেনে নিতে পারে। যদি ভোক্তারা তা মানিয়ে নিতে পারে, অর্ডার বাড়ার সম্ভাবনা আছে।”
দেশের শীর্ষ রপ্তানিকারক স্নোটেক্স গ্রুপ গত অর্থবছরে প্রায় ৩০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যার এক-তৃতীয়াংশই যুক্তরাষ্ট্রে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ জানালেন, “গত বছর এক মার্কিন ক্রেতা ৭ লাইনে উৎপাদন করালেও এবার ১৭ লাইনের সমান অর্ডার দিতে চাইছে। আরেক ক্রেতা ২০ লাইনের অর্ডার থেকে আরও ১০-১৫ লাইনের পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এগুলো সামলাতে অন্তত আড়াই লাখ ডলার বিনিয়োগ লাগবে। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে চলতি অর্থবছরে রপ্তানি ৩৫ কোটি ডলারের বেশি হতে পারে।”
স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি শোভন ইসলাম আরও জানান, “আগামী বসন্তে আমাদের অর্ডার আগের তুলনায় ৫-১০ শতাংশ এবং গ্রীষ্মে ১০-১৫ শতাংশ বেশি হবে। আমরা ওভারটাইম ঘণ্টা ২ থেকে বাড়িয়ে ৩ ঘণ্টা করেছি। ভারতের ও চীনের অর্ডার বাংলাদেশে ধরে রাখতে সরকারের সহায়তা অপরিহার্য।”
চীনের হান্ডা গার্মেন্টস কোম্পানি মিরসরাই বেপজায় প্রায় ৪ কোটি ডলার বিনিয়োগে কারখানা স্থাপন করছে। একই অঞ্চলে খাইশি গ্রুপও অন্তর্বাসসহ বিভিন্ন পোশাক উৎপাদনে সমপরিমাণ বিনিয়োগের চুক্তি করেছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বেপজা ৩৪টি চীনা বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে, যার মধ্যে ৮টি চুক্তিবদ্ধ হয়েছে এবং মোট বিনিয়োগ প্রায় ১৫ কোটি ডলার। এসব কারখানায় পোশাকের পাশাপাশি ব্যাগ ও হালকা প্রকৌশল পণ্যও উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “চীনা বিনিয়োগ কেবল মূলধনই আনবে না, নতুন ক্রেতাও আনার সম্ভাবনা আছে। তবে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হলে ব্যাংক সহায়তা, স্থিতিশীল বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ এবং কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজ করাটাই মূল চাবিকাঠি।”
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য এই সময়টি এক ধরনের ‘স্বর্ণযুগ’ হয়ে উঠতে পারে, যদি সরকার এবং শিল্পপতি মিলিয়ে সঠিক নীতি গ্রহণ করেন এবং নতুন বিনিয়োগকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো যায়।