বিগত দেড় দশকে দেশে কয়েকটি ব্যয়বহুল মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এই প্রকল্পগুলোতে বাজেটের তুলনায় খরচ বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। বিশেষ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আটটি প্রকল্পে বাজেটের বাইরে ৭ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে এই আট প্রকল্পের মোট বাজেট ধরা হয়েছিল ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। বাস্তবায়নের সময় ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি এবং অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এ পরিস্থিতি শুধু এই আট প্রকল্পে সীমাবদ্ধ নয়। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর মাধ্যমে আরও বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। রাষ্ট্র উন্নয়নের নামে এসব প্রকল্প নেওয়া হলেও, এগুলো অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। অতিরিক্ত ব্যয় মূলত পরিকল্পিত লুটপাটের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকল্পগুলোর অতিরিক্ত ব্যয়ের পেছনে রয়েছে কয়েকটি কারণ। এর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, পরিকল্পনা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ত্রুটি, জমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতার অভাব, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং বাস্তবায়নে বিলম্ব। এ সব মিলিয়ে প্রকল্প ব্যয় প্রাথমিক বাজেটের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।

প্রকল্পগুলোর ব্যয় ও সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যাচাই করা জরুরি। এতে ভবিষ্যতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ত্রুটি অনেকটাই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তবে এ কাজের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা প্রয়োজন। কারণ দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা নিয়ে প্রায়ই বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন উঠে। খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অধিকাংশ মেগা প্রকল্পই বিদেশি পরামর্শক এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়েছে। তাই এই প্রকল্পগুলোর নিরীক্ষাও আন্তর্জাতিক মানের কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে করা উচিত।
প্রকল্প বাস্তবায়নের বাড়তি ব্যয়ের দায় তৎকালীন নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদদের ওপর বর্তায়। জনগণের কর ও বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার করে নেওয়া এসব প্রকল্পের অনিয়ম ও অপচয় তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেসরকারি ব্যাংক খাতের ফরেনসিক অডিটের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একইভাবে মেগা প্রকল্পের মূল্যায়ন ও নিরীক্ষার ব্যবস্থা সরকারের গ্রহণ করা উচিত। নিরীক্ষা যেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হয়, এজন্য তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা উত্তম।
এখানেই শেষ নয়। কেবল আটটি প্রকল্প নয়, বিগত সরকারের আমলে বাস্তবায়িত সব মেগা প্রকল্প নিরীক্ষার আওতায় আনা প্রয়োজন। অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণ ও দায়ীদের চিহ্নিত করা ছাড়াও, ভবিষ্যতের প্রকল্প কীভাবে ব্যয় সাশ্রয়ী ও স্বচ্ছভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেটাও নিরীক্ষার লক্ষ্য হতে হবে। নিরীক্ষার মাধ্যমে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে জবাবদিহি ও শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি। এর মাধ্যমে নতুন কোনো প্রকল্পে অপচয় ও দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবে। উন্নয়নের নামে অর্থ অপচয় ও দুর্নীতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারকে এ বিষয়ে সতর্ক ও তৎপর হতে হবে।

বর্তমানে জানা গেছে, সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই মেগা প্রকল্পগুলোর তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নিরীক্ষা করার। বিভিন্ন প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কাজ করছে। তবে সংস্থাটি বিগত সময়ে নানা কারণে সমালোচিত হয়েছে। শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। অর্থনীতিবিদরা এটি ‘নখদন্তহীন বাঘ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। গণ-অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি কিছুটা বদলেও, মেগা প্রকল্প মূল্যায়নে দুদকের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ থেকে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারের উচিত দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে প্রকল্প নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন স্বচ্ছ, ব্যয় সাশ্রয়ী ও দায়বদ্ধ হবে। নজরদারি ও মূল্যায়নের অভাবে দেশে প্রায় প্রতিটি খাতেই দুর্নীতির বহুমুখী চর্চা হয়েছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় না আনা এবং প্রশাসনে জবাবদিহির অভাবে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার এক বছরে বেসরকারি ব্যাংক, আর্থিক খাতের অলিগার্কসহ বেসরকারি খাতের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত ও নিরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি প্রশংসনীয়। একইভাবে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, বিগত সরকারের শাসনামলে লুটপাটের প্রধান মাধ্যম হওয়া প্রকল্পগুলোও যাচাইয়ের আওতায় আনা হবে। কিন্তু তা হয়নি।
সরকারকে কেবল নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়াই যথেষ্ট নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের বিষয়েও নজর দিতে হবে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বেশির ভাগ প্রকল্প শীর্ষ পর্যায় থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়। এখানে মন্ত্রী, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক দাতাদের ভূমিকা ছিল। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতো। এরপর তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হতো। সেখানে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম চালানো হয় এবং উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হয়। এতে দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হতো। তবে প্রকল্পগুলো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ায় সম্ভাব্যতা যাচাই প্রায় ক্ষেত্রেই উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রকল্পের সুবিধা ও ব্যয় অনেক সময় বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
দেশের বেশির ভাগ প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। এর অন্যতম কারণ হলো প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা না হওয়া। এর ফলে পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোর পরিচালন ব্যয়ের জন্য কোনো সংস্থান থাকে না। অতীত থেকে দেখা গেছে, প্রকল্প পরিকল্পনার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যতে কোনো প্রকল্প যেন রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতেও অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, তা পূরণের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপ্রয়োজনীয় ও অলাভজনক প্রকল্প বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সব প্রকল্পের পুনর্মূল্যায়ন এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি।
উন্নয়নের নামে নেওয়া মেগা প্রকল্পগুলো যদি সঠিক পরিকল্পনা, সম্ভাব্যতা যাচাই ও নিরীক্ষার আওতায় না আসে, তা শুধুই বাজেট বৃদ্ধি এবং দুর্নীতির সুযোগ বাড়ায়। অতিরিক্ত ব্যয় ও অপচয় বন্ধ করতে প্রয়োজন সতর্ক নজরদারি, নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নিরীক্ষা এবং পরিকল্পিত বাস্তবায়ন।
সরকারকে এখন শুধু অতীত প্রকল্পগুলো যাচাই করতে হবে না, ভবিষ্যতের প্রকল্পও স্বচ্ছ, ব্যয় সাশ্রয়ী ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এতে প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় রোধ হবে, জনগণের অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগবে এবং দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে। উন্নয়নের নামে দুর্নীতি ও অপচয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

