বাংলাদেশে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার প্রধান জ্বালানি হলো ব্যাংক ঋণ। কিন্তু সেই ঋণই এখন উদ্যোক্তাদের জন্য পরিণত হয়েছে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতায়। ঋণের সুদের হার এত দ্রুত বেড়েছে যে, ১৫ থেকে ১৬ শতাংশে পৌঁছে অনেক শিল্পোদ্যোগী শ্বাস নিতে পারছেন না।
অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, সুদের এই অস্বাভাবিক চাপ চলতে থাকলে শুধু অর্থনীতির গতি মন্থর হবে না, শিল্প উৎপাদন থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান পর্যন্ত বড় ধাক্কা খাবে। ব্যবসায়ীরা আরও সরাসরি বলছেন— এখনকার সুদহার ব্যবসা করার চেয়ে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
ব্যাংক খাতে ঋণের সুদের হার ও আমানতের সুদের হার— এই দুইয়ের ব্যবধানকে বলা হয় স্প্রেড। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এ ব্যবধান ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে ছবিটা ভয়াবহ ভিন্ন। জুলাই মাসের হিসাব বলছে, গড় স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৫.৭৫ শতাংশে। ১৮টি ব্যাংকে এই ব্যবধান ৬ থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত।
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান সর্বোচ্চ ১৩.৯৪ শতাংশ স্প্রেড করেছে, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে এ হার ১০.৩৫ শতাংশ। দেশীয় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ৯.৫২ শতাংশে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, যেখানে ঋণের সুদ ১৬ শতাংশের ওপরে গেছে।
ভারত, নেপাল বা শ্রীলঙ্কায় যেখানে স্প্রেড ৩ শতাংশের নিচে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান কার্যত দ্বিগুণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও ব্যাংকারদের বৈঠকে সতর্ক করে বলেছেন, ৫–৮ শতাংশ স্প্রেড ব্যবসার জন্য ধ্বংসাত্মক। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে যেটা ৩ শতাংশের নিচে, আমাদের ব্যাংকগুলো সেটা লাগামছাড়া করে ফেলেছে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকির মুখে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিপর্যয়ের পেছনে আছে একাধিক কারণ—
আইএমএফের শর্তে বাজারভিত্তিক সুদ চালু করা
স্প্রেডের ওপর সীমা তুলে নেওয়া
বারবার নীতি সুদহার বৃদ্ধি
ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ
ব্যাংকের উচ্চ পরিচালন ব্যয়
সঞ্চয়পত্রে বেশি মুনাফা
সব মিলিয়ে মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ঋণের গড় সুদ ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫–১৬ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।
দুই বছর আগেও পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। ২০১৯ থেকে কার্যকর হওয়া সুদের ‘ক্যাপ’-এর কারণে ঋণের সুদ ৯ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এক বছর আগে, অর্থাৎ ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্তও গড় সুদ ছিল ৯.৫–১০ শতাংশ। কিন্তু বাজারভিত্তিক পদ্ধতি চালুর পর ঋণের সুদ দ্রুত বাড়তে শুরু করে। এখন জুলাই ২০২৫-এ এসে তা ১৬ শতাংশ ছুঁয়েছে।
নিটওয়্যার রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের ভাষায়, “স্প্রেড কোনোভাবেই ২-৩ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। অথচ আমাদের দেশে তা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই সুদে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, কারখানা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।”
তার দাবি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত দ্রুত হস্তক্ষেপ করা, বিশেষ করে ঋণ শ্রেণিকরণে কড়াকড়ি শিথিল করা না হলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সংকট আরও গভীর হবে।
উচ্চ সুদ ও অস্বাভাবিক স্প্রেডের প্রভাব পড়ছে তিনটি জায়গায় সবচেয়ে বেশি—
- বিনিয়োগ থমকে যাচ্ছে — উদ্যোক্তারা নতুন শিল্পে ঝুঁকতে পারছেন না।
- কর্মসংস্থান কমছে — নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে না, পুরনো শিল্প টিকছে না।
- অর্থনীতির গতি মন্থর হচ্ছে — প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ, নীতি-নির্ধারকদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোরতা, ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা সামঞ্জস্য করা এবং প্রয়োজনে স্প্রেডের ওপর আবার সীমা আরোপ— এগুলো ছাড়া সমাধান নেই।

