কুমিল্লার রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) এবার রেকর্ড গড়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও প্রতিষ্ঠানটি ৯০২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। এটি প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠার পর সর্বোচ্চ রফতানি। এর ফলে কেবল জাতীয় অর্থনীতিই নয়, স্থানীয় অর্থনীতিও নতুন মাত্রা পেয়েছে।
ইপিজেডটি কুমিল্লার দক্ষিণ চর্থা এলাকায় ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এখানে ৫০ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। গত তিন অর্থবছরে পণ্য রফতানি করেছে মোট ২,৯৩৩.৬৪ মিলিয়ন ডলার। যদিও ২০২১-২৪ সালের মধ্যে রফতানি কিছুটা কমে গিয়েছিল, গত অর্থবছরে তা আবার বৃদ্ধি পেয়েছে।
কুমিল্লা রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সহকারী পরিচালক এএইচএম এরশাদুর রহমান জানান, করোনার সময় অনেক অর্ডার বন্ধ ছিল। এছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সরবরাহ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা অর্ডার বাড়িয়েছেন, ফলে রফতানি বেড়ে গেছে। ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহবুবও এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
রফতানির ৯৫ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রে। এছাড়া জাপান ও অন্যান্য কয়েকটি দেশে রফতানি বেশি। বিনিয়োগে শীর্ষে রয়েছে অন্তত ১৫টি দেশ। বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, কানাডা, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও হংকং ইপিজেডে বিনিয়োগ করেছে।
ইপিজেডে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে: গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ, সোয়েটার, ফেব্রিক্স, টেক্সটাইল ডাইজ, ইলেকট্রনিকস পার্টস, ফুটওয়্যার, ক্যামেরা কেস, ব্যাগ, প্লাস্টিক পণ্য, হেয়ার ও ফ্যাশন অ্যাকসেসরিজ, মেডিসিন বাক্স, কার্পেট, গ্লাভস, লাগেজ, পেপার প্রোডাক্ট ইত্যাদি। এছাড়া এখানে বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডের বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় পণ্যও তৈরি ও রফতানি হয়।
বর্তমানে এখানে ৫২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, যার মধ্যে ৪৬টি উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৬১৩ মিলিয়ন ডলার। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছে।
ইপিজেডে তিন ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে – বিদেশি মালিকানাধীন ৩১টি, যৌথ মালিকানাধীন ৮টি এবং দেশি মালিকানাধীন ১৩টি। রফতানিতে শীর্ষে রয়েছে চীনা মালিকানাধীন মেসার্স কাদেনা স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯১.৬২ মিলিয়ন ডলার রফতানি করেছে। এছাড়া সুরতি টেক্সটাইল, নাসা তেইপ ডেনিমস, জিংস্যাং সুজ ও ইস্টপোর্ট লিমিটেডও শীর্ষ রফতানিকারক।
নতুন বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকলেও সব প্লট ইতিমধ্যেই বরাদ্দ হয়ে গেছে। তাই নতুনদের জন্য প্লট দিতে পারা সম্ভব হচ্ছে না। ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহবুব বলেন, “সরকার যদি প্লট বাড়ায়, তাহলে নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করা সম্ভব।”
ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিকদের ৬৬ শতাংশই নারী, যারা নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করছেন। নাঙ্গলকোট উপজেলার মনোয়ারা বেগম তার দুই সন্তানকে দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, “স্বামী চলে যাওয়ার পর কীভাবে চলবে ভাবছিলাম। এখন এখানে কাজের মাধ্যমে ভালোই চলছে।”
প্রতি মাসে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। এছাড়া প্রায় ২৭০ বিদেশি কর্মী শহরের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করেন। এর ফলে চর্থা এলাকার অর্থনীতি, বাসা ভাড়া, বাজার ও কর্মসংস্থান সবই নতুন রূপ পেয়েছে। ইপিজেডের আশেপাশের এলাকার মানুষের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই শিল্পাঞ্চল।

