শ্রম আইন সংশোধন করে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠন আরও সহজ করতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এখনকার আইনে কোনো প্রতিষ্ঠানে ইউনিয়ন করতে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি লাগে। নতুন খসড়ায় এ শর্ত বদলানো হয়েছে। ন্যূনতম ২০ জন শ্রমিকের সমর্থন থাকলেই ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ থাকছে। তবে এতে কারখানায় বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শ্রমিকনেতা ও মালিকপক্ষের একটি বড় অংশ।
শ্রমিকনেতাদের একাংশ বলছেন, মাত্র ২০ জন শ্রমিকের সম্মতিতে ইউনিয়ন করার সুযোগ নিলে মালিকপক্ষ, রাজনৈতিক দল কিংবা বাইরের কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সহজেই ইউনিয়ন গঠন করে ফেলতে পারবে। এতে প্রকৃত শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষার পরিবর্তে দর–কষাকষির ক্ষমতা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে মালিকপক্ষ বলছে, এ ধরনের বিধান বাস্তবায়িত হলে শিল্পকারখানায় বিভাজন ও অস্থিরতা বাড়বে। যা শেষ পর্যন্ত শ্রমিক ও মালিক—উভয়ের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।
শ্রম আইন সংস্কারের দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তাদের চাপের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার শ্রম আইন সংশোধনের রূপকল্প তৈরি করেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার সেই প্রক্রিয়াই এগিয়ে নিচ্ছে। গত মার্চে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে আইএলওর বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। পরে জানানো হয়, আইনের ১০১টি ধারা–উপধারা সংশোধন করা হবে।
এরপর শ্রম কমিশনের সুপারিশে আরও কিছু পরিবর্তন আনা হয়। সর্বশেষ ২৬ আগস্ট ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদে (টিসিসি) এ নিয়ে দিনভর আলোচনা হয়। টিসিসিতে সরকার, মালিক ও শ্রমিক—তিন পক্ষের ২০ জন করে প্রতিনিধি রয়েছেন।
প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো
খসড়ায় বলা হয়েছে, একটি প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ২০ জন শ্রমিকের সম্মতিতে ইউনিয়ন গঠন করা যাবে। তবে একটি কারখানায় পাঁচটির বেশি ইউনিয়ন করা যাবে না। ইউনিয়ন যৌথ দর–কষাকষির প্রতিনিধি (সিবিএ) হবে তখনই, যদি গোপন ব্যালটে নির্বাচনে তারা ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পায়।
শ্রমিকনেতাদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন প্রস্তাবে একমত হলেও অনেকেই সতর্ক করছেন। তাঁদের মতে, নিবন্ধন ও নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ না হলে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার পরিবর্তে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। শ্রমিকনেতা বাবুল আখতার বলেন, “ইউনিয়ন সহজ করতে হলে আগে শ্রম অধিদপ্তরের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। আর নিশ্চিত করতে হবে ইউনিয়ন করলে শ্রমিকের চাকরি যাবে না। না হলে প্রকৃত শ্রমিকদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন (বিইএফ) আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, শিল্পের বাস্তবতা উপেক্ষা করে এ প্রস্তাব আনা হয়েছে। এতে বাইরের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করবে এবং কর্মক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “কম্বোডিয়ায় পাঁচটি ইউনিয়নের সুযোগ থাকায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল। আমাদের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা চলছে। হঠাৎ করে ২০ জন শ্রমিকের প্রস্তাব কোথা থেকে এল, তা বোধগম্য নয়।”
বর্তমানে দেশে প্রায় ১০ হাজার ট্রেড ইউনিয়ন আছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪০০। তবে অধিকাংশ ইউনিয়নই নিষ্ক্রিয়। ইউনিয়ন নিবন্ধনে নানা অজুহাত দেখিয়ে আবেদন বাতিল করার প্রবণতাও আছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে মালিকরা নিজেদের লোকজন দিয়ে ইউনিয়নের নিবন্ধন নিয়ে নেন। ফলে শ্রমিকদের প্রকৃত দর–কষাকষির জায়গাটি দুর্বল থেকে গেছে।
অভিজ্ঞ শ্রমিকনেতারা সতর্ক করে বলেছেন, নতুন আইনে ২০ জন শ্রমিকের শর্ত থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে শত শত প্রতিষ্ঠানে ইউনিয়ন নিবন্ধন হতে পারে। এতে প্রকৃত শ্রমিকদের সুযোগ না থেকে বাইরের গোষ্ঠীর প্রভাব বাড়বে। অন্যদিকে সিবিএ নির্বাচনের চাপ সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতাও সরকারের নেই।
শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “শ্রম আইন সংশোধন নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। এখন আর আলোচনার সুযোগ নেই। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আইন চূড়ান্ত করা হবে।”

