বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের দেশ। ২০২৪ সালে দেশে বিতরণ করা মোট ঋণের ২০.২ শতাংশ খেলাপি হয়েছে। এ তথ্য উঠে এসেছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে।
গত মাসে প্রকাশিত এডিবির ‘ননপারফর্মিং লোনস ওয়াচ ইন এশিয়া ২০২৫’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০.২৭ বিলিয়ন ডলারে। এটি আগের বছরের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে এশিয়ার ‘সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার’ দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় এক বছরে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে ১১.২ শতাংশ পয়েন্ট। অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা তাদের খেলাপি ঋণ কমাতে পেরেছে। নেপালে সামান্য বেড়েছে, মাত্র ০.৯ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার বড় অর্থনীতির দেশ ভারত তাদের খেলাপি ঋণ ৩.৪ শতাংশ থেকে ২.৫ শতাংশে নামিয়েছে। এর পেছনে বড় ধরনের ব্যাংক সংস্কারের অবদান রয়েছে।
এডিবি জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দেশ মিলিয়ে ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৬.৭৪ বিলিয়ন ডলার। এটি এশিয়ার মোট খেলাপি ঋণের ১২.৪ শতাংশ। আগের বছরের তুলনায় এই অঙ্ক কমেছে। বাংলাদেশে তবে উল্টো চিত্র। ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ১৫.৮০ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭.৭ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে বেড়ে ৯ শতাংশে পৌঁছেছে। এডিবি বলেছে, বাংলাদেশে ঋণ প্রদানের নিয়মকানুন দুর্বল এবং খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থাও কার্যকর নয়। ফরেনসিক অডিটে ৬টি ইসলামি ব্যাংকের লুকানো মন্দ ঋণের তথ্যও প্রকাশ হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দীর্ঘদিনের শিথিল নিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব ও আগের সরকারের নীতি এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, আগের সরকার ঋণের নিয়ম শিথিল করেছিল। বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করে দেখানো হতো, যেন খেলাপি ঋণের প্রকৃত ছবি না বোঝা যায়। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করছে। নিয়ম যত কড়া হবে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ তত বেড়ে যাবে। তিনি ভারতের উদাহরণ টেনে বলেন, একসময় ভারতও খেলাপি ঋণে ডুবে ছিল। কিন্তু কঠোর সংস্কারের মাধ্যমে তারা সমস্যা অনেকটা সামলেছে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ভারতের মতো বাংলাদেশকেও কঠোর নিয়ম প্রয়োগ করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু পরিবর্তন এসেছে। তিনি বলেন, নেপালও এখন বাংলাদেশের তুলনায় ভালোভাবে ঋণ ব্যবস্থাপনা করছে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানও তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী কাঠামো বজায় রেখেছে। সেলিম রায়হান জানান, আগের সরকার ঋণ ব্যবস্থায় শিথিলতা আনার কারণে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হতো। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা প্রচুর ঋণ নিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশ ছাড়াও দিয়েছে বা দুর্নীতির মামলায় জড়িত। তাদের সব ঋণ এখনও খেলাপি হিসেবে ধরা হয়নি। যদি তারা টাকা ফেরত না দেয়, খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে।
তিনি মনে করেন, শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিবর্তন নয়, বরং আইন কঠোর করা, মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় বাড়ানো এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা জরুরি। এই সংস্কার আগামী নির্বাচিত সরকারকেও চালিয়ে যেতে হবে। এডিবি বলেছে, এশিয়ার খেলাপি ঋণের বাজারে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তবে বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দা, বাণিজ্য দ্বন্দ্ব ও ভূরাজনৈতিক সংকট আবারও ঋণ বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে যেসব দেশ ঋণনির্ভর বা বাইরের বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল তারা ঝুঁকিতে আছে।
এডিবির পরামর্শ হলো, কঠোর আইন প্রয়োগ, কার্যকর বাজার ব্যবস্থা এবং দ্রুত নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া বিচারব্যবস্থা আরও দক্ষ করা, বাজার স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে এশিয়ায় খেলাপি ঋণের সমস্যা কার্যকরভাবে সামলানো সম্ভব।

