অবসরের পর নিরাপদ জীবন আজ আর বিলাসিতা নয়, এটি মৌলিক প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমবর্ধমান প্রসারিত হচ্ছে। এসবের প্রেক্ষাপটে অনেকেই ভাবছেন—আজকের সঞ্চয় কি আগামী দিনে আর্থিকভাবে সুরক্ষিত অবসর নিশ্চিত করতে যথেষ্ট হবে?
অবসরকালীন সময়ের আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে শুধু টাকা জমিয়ে রাখলেই হবে না। প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। সঠিক সময়ে সঞ্চয় করা, যুক্তিসঙ্গত বিনিয়োগ করা এবং ঝুঁকি সঠিকভাবে পরিচালনা করাই মূল বিষয়। এভাবে নীতি মেনে চললে অবসরকালীন জীবন আর্থিকভাবে নিরাপদ ও সচ্ছল করা সম্ভব।
বাংলাদেশের কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি আমানত পরিকল্পনা এবং পেনশনভিত্তিক সঞ্চয় স্কিমগুলো অফার করছে, অন্যদিকে বীমা কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত সুরক্ষা প্রদানের জন্য বিভিন্ন স্কিম এবং পেনশনভিত্তিক জীবন বীমা অফার করছে। এছাড়া সরকারের জাতীয় পেনশন প্রকল্প একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষকে তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার সুযোগ প্রদান করবে। এ প্রতিশ্রুতিশীল সুযোগগুলো সত্ত্বেও অনেক মানুষ কীভাবে এগুলো থেকে অবসর জীবনে সঠিক আর্থিক সুবিধা পেতে পারেন সে সম্পর্কে অসচেতন। এক্ষেত্রে আর্থিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যা প্রতিটি নাগরিককে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আর্থিক পরিকল্পনা ও সঞ্চয় করতে এবং মর্যাদার সঙ্গে অবসর গ্রহণ করতে সক্ষম করে তোলেন।
আর্থিক শিক্ষা মানুষের অবসরকালীন সঞ্চয়কে কীভাবে গড়ে তুলে এবং কীভাবে জীবনের প্রথম পর্যায়ে অন্তর্ভুক্তি লাভজনক করে তার ধারণা দেয়। এটি চক্রবৃদ্ধি মুনাফা, মুদ্রাস্ফীতি, ঝুঁকি বৈচিত্র্যকরণ ও দীর্ঘমেয়াদি বাজেটের মতো মূল ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করে, যা অবসর জীবনের পেনশন সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা প্রদান করে।
জাতীয় পেনশন প্রকল্প চালু করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার তার নাগরিকের জন্য আরো নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক উভয় ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষ রাষ্ট্র দ্বারা সমর্থিত অবসর সঞ্চয় পরিকল্পনার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে এ উচ্চাভিলাষী উদ্যোগের সাফল্য অনেকটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, আর্থিক শিক্ষা।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম (ইউপিএস) চালু করা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা চারটি ভিন্ন মডিউলে বিভক্ত—প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা এবং প্রবাসী—এ স্কিমগুলো বেসরকারি খাতের কর্মচারী, অনানুষ্ঠানিক কর্মী, নিম্ন আয়ের গোষ্ঠী এবং প্রবাসীসহ সব নাগরিকের জন্য তৈরি করা হয়েছে। মানুষ এখন তাদের কর্মজীবনে স্বেচ্ছায় পেনশন অ্যাকাউন্টে অবদান রাখতে পারেন এবং ৬০ বছর বয়সের পরে মাসিক পেনশন পেতে পারেন। এ ব্যবস্থাটি ডিজিটাল, প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে বেশি স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। যদিও প্রাথমিক তথ্য থেকে জানা যায় যে সচেতনতা ও অংশগ্রহণ কম, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের বাইরে।
উদাহরণস্বরূপ, একজন ৩০ বছর বয়সী ব্যক্তি যিনি প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা জাতীয় পেনশন স্কিমে জমা করেন, তিনি ৬০ বছর বয়সের পরে একটি মাসিক আয় পাবেন কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ের মূল্য ও চক্রবৃদ্ধির ক্ষমতা না বুঝে, অনেকেই এ ক্ষুদ্র পরিমাণ অর্থও দিতে অনিচ্ছুক। এছাড়া আর্থিক দুর্দশার সময় মাসিক কিস্তির সঠিক ব্যবস্থাপনা বা সমন্বয় করার ধারণা সম্পর্কে অবগত নন।
বাংলাদেশের শ্রমজীবীরা এখনো অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের দ্বারা প্রভাবিত, যেমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক, কৃষক, দিনমুজুর, কৃষক, গৃহকর্মী ইত্যাদি। এ পেশাজীবী মানুষের আনুষ্ঠানিক অবসর পরিকল্পনার কোনো সুযোগ কখনই ছিল না। জাতীয় পেনশন স্কিম তাদের জন্য একটি স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।
তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হচ্ছে আর্থিক সচেতনতার নিম্ন স্তর। বেশির ভাগ মানুষেরই এ প্রকল্প সম্পর্কে তথ্যের অভাব রয়েছে, তাদের ব্যক্তিগত বাজেটের সঙ্গে এটি কীভাবে খাপ খায় তা মূল্যায়ন করার আর্থিক দক্ষতা তো দূরের কথা, সামান্য ধারণা এ ব্যাপারে অনেকেরই নেই। যদি আর্থিক শিক্ষার প্রচারণা না থাকে, যাদের এ স্কিম সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদেরই এ প্রকল্পের নাগালের বাইরে থাকবে।
অবসরকালীন-প্রস্তুত সমাজ গঠন শুরু হয় শিক্ষা এবং সচেতনতা দিয়ে। যেহেতু এর গুরুত্ব অনেক, তাই স্কুল পাঠ্যক্রমের মধ্যে আর্থিক সাক্ষরতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখন সঞ্চয়, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, পেনশন এবং বীমার মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে শিখতে সক্ষম।
ব্যাংকগুলো মানুষের সুস্থ অবসর গ্রহণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তারা এরই মধ্যে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি আমানত পণ্য, পেনশন-ভিত্তিক ডিপিএস স্কিম ও বোনাস সঞ্চয় পরিকল্পনা চালু করেছে, যা সুশৃঙ্খল সঞ্চয় অভ্যাসকে উৎসাহিত করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকগুলো অবসর জীবনের কথা বিবেচনা করে বিদ্যমান পণ্যগুলো সংশোধন করে। বেশ কয়েকটি ব্যাংক তাদের ডিপিএস (ডিপোজিট পেনশন স্কিম) পণ্যগুলোর সঙ্গে বীমা সুবিধা প্রদান করে।
এ স্কিমগুলোয় প্রায়ই জীবন বীমা, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু কভারেজ বা অক্ষমতা সুবিধা অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা আমানতকারীদের জন্য অতিরিক্ত সুরক্ষা প্রদান করে। মিডল্যান্ড ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এবং আরো অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তরুণ ও কর্মজীবীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আর্থিক সাক্ষরতা প্রচারণা পরিচালনা করে। বীমা কোম্পানিগুলো বিশেষভাবে তৈরি অবসর পরিকল্পনা, বার্ষিকী এবং পেনশন জীবন বীমা প্রদান করছে। এ পণ্যগুলো কেবল রিটার্ন প্রদান করে না বরং কিছু ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত স্বাস্থ্য বা জীবনের ঝুঁকির বিরুদ্ধে সুরক্ষাও নিশ্চিত করে।
গণমাধ্যমও একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। জনসেবা, টিভি টক শো, সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণা ইত্যাদির মাধ্যমে দর্শকদের কাছে অবসর পরিকল্পনাকে সহজ এবং সুন্দরভাবে প্রচার করতে পারেন। মেসেজটি স্পষ্ট হওয়া উচিত: অবসরের পরিকল্পনা করার জন্য আপনাকে ধনী হতে হবে না—আপনাকে কেবল ধারাবাহিক এবং সচেতন হতে হবে।
আর্থিক শিক্ষার প্রসার করতে বাংলাদেশের ডিজিটাল ব্যাংকিং অবকাঠামোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। মোবাইল আর্থিক পরিসেবা অবসরকালীন সঞ্চয় আচরণ নিয়ে প্রচারের জন্য প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে। ডিজিটাল ক্যালকুলেটর, চ্যাটবোট এবং পেনশন ট্র্যাকিং সরঞ্জাম ব্যবহারকারীদের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাদের সঞ্চয় পরিচালনা করার ক্ষমতা দিতে পারে।
জাতীয় পেনশন প্রকল্প একটি সাহসী এবং প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোগ, যা বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো দীর্ঘস্থায়ী করে। কিন্তু এটিকে সত্যিকার অর্থে জাতীয় সাফল্যে পরিণত করার জন্য, সরকারের পেনশন অবকাঠামোর পাশাপাশি আর্থিক শিক্ষাকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন যার মাধ্যমে সরকার জনগণের অধিক”বিশ্বাস”অর্জন করতে পারবে।
প্রতিটি নাগরিক, নারায়ণগঞ্জের পোশাক শ্রমিক হোক বা রাজশাহীর ক্ষুদ্র ব্যবসার মালিক, তাদের অবসরের পরিকল্পনা করার জন্য জ্ঞান এবং আত্মবিশ্বাসী হওয়া উচিত। সঠিক সচেতনতা, উন্নত ব্যবস্থা এবং ব্যাপক শিক্ষার মাধ্যমে, আমরা এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারি যারা অনুশোচনায় নয়, বরং মর্যাদা এবং শান্তিতে অবসর গ্রহণ করবেন।
মো. রাশেদ আকতার, হেড অব রিটেইল ডিস্ট্রিবিউশন ডিভিশন, ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি উইং অ্যান্ড চিফ ব্যাংকাস্যুরেন্স অফিসার (সিবিও, মিডল্যান্ড ব্যাংক পিএলসি। সূত্র: বনিক বার্তা