অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর প্রধান এএফএম শাহীনুল ইসলামের নিয়োগ বাতিল করেছে। গতকাল মঙ্গলবার জারি করা এক অফিস আদেশে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
এর আগে তার বিরুদ্ধে ভিডিও কেলেঙ্কারি ও অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হলে বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, বিতর্কিত ব্যবসায়ী খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ফ্রিজ করা অ্যাকাউন্ট থেকে ১৯ কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ দেন শাহীনুল ইসলাম। এছাড়া তার নিজস্ব ও স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবেও অস্বাভাবিক নগদ জমার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আপত্তিকর ভিডিওর ফরেনসিক পরীক্ষাও সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
গত ১৮ আগস্ট ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে উত্তেজনা দেখা দেয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিবাদের মুখে তিনি অফিস ছাড়তে বাধ্য হন। তদন্ত চলাকালীন তাকে ছুটিতে পাঠানো হয়। দীর্ঘদিনের টানাপড়েন শেষে নিয়োগ বাতিলের মাধ্যমে তার অধ্যায় সমাপ্ত হলো।
পটভূমিতে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন একেএম এহসান। তিনি প্রভাবশালী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেন। তবে রাজনৈতিক ও অদৃশ্য চাপের কারণে স্থায়ীভাবে নিয়োগ পাননি। সার্চ কমিটির তালিকায় নাম না থাকা সত্ত্বেও চলতি বছরের জানুয়ারিতে শাহীনুল ইসলাম বিএফআইইউ প্রধান হন। শুরু থেকেই নিয়োগটি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিয়োগ বাতিলকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, গড়িমসি ও অনিয়ম প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করলেও অবশেষে পদক্ষেপ নেওয়ায় আর্থিক খাতে আস্থা ফিরে আসবে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, শাহীনুল ইসলামের আপত্তিকর ভিডিও ফরেনসিক পরীক্ষায় সত্যতা পেয়েছে। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে জব্দ করা কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও নেতার ব্যাংক হিসাব থেকে অবৈধভাবে টাকা উত্তোলনের তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে।
তদন্তে দেখা গেছে, বিতর্কিত পরিবহন ব্যবসায়ী খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ থাকার পরও ১৯ কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ দিয়েছেন শাহীনুল ইসলাম। তার নিজস্ব ব্যাংক হিসাবেও অনিয়ম মিলেছে। ডাচ বাংলা ব্যাংকে শাহীনুল ও তার স্ত্রীর দুটি হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৪, ৫ ও ১২ মে বিভিন্ন সময়ে এক ব্যক্তি তাদের হিসাবগুলোতে নগদ টাকা জমা করেছেন।
১৮ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শাহীনুল ইসলামের আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ভিডিওগুলোকে ভুয়া দাবি করলেও ১৯ আগস্ট অফিসে উপস্থিত ছিলেন না। পরদিন অফিসে ফেরার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরিস্থিতি মোকাবেলায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গভর্নরের কাছে স্মারকলিপি দেন। এতে উল্লেখ করা হয়, শাহীনুল রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। পরে প্রতিবাদের মুখে তিনি পেছনের দরজা দিয়ে ব্যাংক ত্যাগ করেন। সরকারের নির্দেশে তাকে অফিসে না আসার জন্য ছুটিতে পাঠানো হয় এবং এরপর তিনি আর কর্মস্থলে ফিরে যাননি।
অর্থ মন্ত্রণালয় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির নেতৃত্ব দেন অতিরিক্ত সচিব সাঈদ কুতুব। সদস্যরা ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম, আইসিটি বিভাগের পরিচালক মতিউর রহমান এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের আন্দোলনের মুখে ৮ আগস্ট ২০২৪ সালে পদত্যাগ করেন বিএফআইইউ-এর তৎকালীন প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস। এরপর ভারপ্রাপ্ত প্রধান হন একেএম এহসান। তার সময়ে শীর্ষ ১০ ব্যবসায়ী গ্রুপ ও সরকারের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানো হয়। প্রায় দেড় হাজার ব্যাংক হিসাব জব্দ এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একেএম এহসানের স্থায়ী নিয়োগে বাধা দেন। অবশেষে চলতি বছরের জানুয়ারিতে শাহীনুল ইসলাম গভর্নরের নেতৃত্বে গঠিত সার্চ কমিটির সুপারিশে বিএফআইইউ প্রধান হন, যদিও তার নাম তালিকায় ছিল না।