যেকোনো দেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের ভূমিকা অপরিহার্য। এটি ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে এসএমই উদ্যোক্তারা গ্রামীণ দারিদ্র্য কমানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।
তবে বাস্তবে এসএমই খাতের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি। আলোচনার বাইরে থেকে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ও অলিগার্ক শ্রেণীই ব্যাংক ও আর্থিক খাত থেকে সহজে ঋণ এবং সরকারি প্রণোদনা পেয়ে আসছিল। তাদের অনেকেই এই সুবিধা দেশের উন্নয়নে নয়, বিদেশে টাকা পাচারের জন্য ব্যবহার করেছে। ফলে দেশের কর্মসংস্থান তেমন বৃদ্ধি পায়নি। এসএমই খাত কর্মসংস্থানের বড় উৎস হতে পারলেও প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা না থাকায় ধুঁকছে। প্রতি বছর দেশে বিশালসংখ্যক তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, কিন্তু তাদের জন্য যথাযথ সুযোগ নেই। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পেছনের একটি মূল কারণও ছিল কর্মসংস্থানের ঘাটতি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ এবং তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধিতে এসএমই খাতের বড় ভূমিকা থাকতে পারে। এজন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তা দিতে হবে এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো বড় শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের ওপর জোর দিয়েছে। এসএমই খাত বড় ও ভারী শিল্পের সহযোগী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চীন ও থাইল্যান্ডের উদাহরণ দেখলেও এ ধরনের দৃশ্যকল্প স্পষ্ট দেখা যায়। তবে বাংলাদেশে এসএমই খাত এখনো বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি। ব্যবসায়ের লাইসেন্স প্রাপ্তি, অসম করহার এবং সহজ ঋণ প্রাপ্তির সংকটের কারণে খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত। যেসব উদ্যোক্তা এসএমই খাতে রয়েছে, তারা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছেন কিন্তু উৎপাদিত পণ্যের বাজারমূল্য ও সংযোজনে এ খাতের ভূমিকা এখনও আশানুরূপ নয়। অর্থায়ন প্রাপ্তির জটিলতা, দক্ষতার অভাব এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করার কারণে খাতটি পিছিয়ে আছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এসএমই খাতের বিকাশ অপরিহার্য। সুযোগের বৈষম্য দূর করা এবং প্রতিবন্ধকতাগুলো সমাধান করা হলে খাতটি দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে বড় অবদান রাখতে পারবে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত জাতীয় জিডিপিতে প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান রাখছে। পাশাপাশি, শিল্প খাতে মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশ এসএমই খাত থেকে আসে। এ তথ্য সাম্প্রতিক ‘বায়ার-সেলার সামিট ২০২৫’-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে শিল্প উপদেষ্টা উল্লেখ করেছেন। অনুষ্ঠানটি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে স্থপতি ইনস্টিটিউটের মাল্টিপারপাস হলে অনুষ্ঠিত হয়। এটি এসএমই ফাউন্ডেশন ও বিশ্বব্যাংক গ্রুপ, বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশের অর্থনীতিতে অলিগার্কদের প্রভাব কমাতে এসএমই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশ অলিগার্কনির্ভর প্রবৃদ্ধি মডেল দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। এই মডেলের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট। জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে উন্নয়ন হয়নি। কর্মসংস্থান তেমন বৃদ্ধি পায়নি এবং বেকারত্ব কমেনি।
এ অবস্থার মোকাবিলায় অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথ অনুসরণ জরুরি। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়নের সহজ অর্থ হলো অর্জিত প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তুলনায় বেশি সংখ্যক মানুষ ও প্রতিষ্ঠান উপকৃত হবে। উদাহরণ হিসেবে, যদি ৮ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধিতে তিনজন ব্যবসায়ী লাভবান হয়, এর চেয়ে বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে যদি ১০ হাজার ব্যবসায়ী লাভবান হন এবং চার লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। এসএমই খাত এই ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখতে পারে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে দেশে নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠবে, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং প্রবৃদ্ধি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে। বর্তমান মডেলে উন্নয়নের সুবিধা মূলত মুষ্টিমেয় ব্যক্তির কাছে সীমিত থাকায় অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসএমই খাতের প্রসার এই বৈষম্য হ্রাস করতে ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
দেশের শিল্প উন্নয়নের মূল শক্তি হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত। জাতীয় জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ৩০ শতাংশ। তবে উদ্যোক্তারা নানামুখী প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন। খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন ঋণ কর্মসূচি থাকলেও প্রত্যাশিত সুবিধা অর্জন করা যায় না। ঋণের পাশাপাশি ব্যবসার নিবন্ধন, শুল্ক-কর, কাঁচামাল আমদানি ও বিপণন প্রভৃতি পর্যায়েও উদ্যোক্তারা সমস্যা ভোগ করছেন। এসএমই উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে অন্তত পাঁচ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে—উচ্চ সুদহার, জামানত বাধ্যবাধকতা, প্রয়োজনীয় নথিপত্রের অভাব, ব্যাংকের ঝুঁকি এড়ানোর মনোভাব এবং ব্যাংক-বহির্ভূত বিকল্প অর্থায়ন সুবিধা না থাকা। বিশেষ করে প্রান্তিক ও নারী উদ্যোক্তারা জামানত সংক্রান্ত বাধার কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন। ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসএমই খাতের বিকাশের জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরি। উদ্যোক্তাদের মূলধনের সহজ জোগান, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য যতটা সম্ভব জামানতবিহীন ঋণ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং নীতিসহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে এসএমই খাতের অবস্থান দৃঢ় করতে পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন বাজারে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এই উদ্যোগগুলি গ্রহণ করলে বাংলাদেশে এসএমই খাত কেবল অর্থনীতির গতিশীলতা বাড়াবে না, বরং কর্মসংস্থান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথও সুগম করবে।
ভবিষ্যতে এলডিসি-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন। এগুলো হলো সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, আর্থিক ও নীতিসহায়তার অভাব, যথাযথ অবকাঠামোর অভাব এবং দক্ষ মানবসম্পদের স্বল্পতা। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, আর্থিক ও নীতিসহায়তা প্রদান, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর, অবকাঠামো খাতের টেকসই উন্নয়ন এবং নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।
চীন, ভারত, থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নয়নশীল ও মধ্যম আয়ের দেশে রফতানি আয়ের বড় অংশ আসে এসএমই খাত থেকে। উদাহরণস্বরূপ, চীনে রফতানির প্রায় ৭০ শতাংশ এসএমই থেকে আসে, থাইল্যান্ডে ৪০ শতাংশের বেশি এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪৩ শতাংশেরও বেশি রফতানি হয় এসএমই উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে। বাংলাদেশে এসএমই খাত জাতীয় জিডিপিতে বড় অবদান রাখলেও রফতানি আয়ে অংশগ্রহণ এখনো সীমিত। দেশের এসএমই থাকলেও এর সিংহভাগই অভ্যন্তরীণ বাজারে সীমাবদ্ধ। হস্তশিল্প, চামড়া, কৃষিভিত্তিক পণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, আইটি ও ই-কমার্স পণ্যসহ বহু খাত রয়েছে, যা বৈশ্বিক বাজারে পৌঁছানোর সক্ষম।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের উদ্যোক্তারা বহির্বিশ্বে ব্যবসা সম্প্রসারণে আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও দক্ষতার অভাবের মুখোমুখি। খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পণ্য বহুমুখীকরণ, বাজার সম্প্রসারণ এবং উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আরও বেশি হারে গবেষণা কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। এর জন্য কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষা ব্যবস্থায় জোর দেওয়া জরুরি। পাশাপাশি রফতানি বাজার অনুসন্ধান এবং সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের এসএমই খাতকে বিস্তৃত করার পরিকল্পনায় এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আর্থিক ও নীতিসহায়তার লক্ষ্যে এসএমই সংজ্ঞায় সংশোধন আনার প্রয়োজনীয়তা বিশেষজ্ঞরা তুলে ধরছেন।
বর্তমান সময়ে অবাধ তথ্যপ্রবাহ খাতের বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দক্ষতা বৃদ্ধির বিকল্পও নেই। বিশেষজ্ঞরা আশা করেন, এসএমই খাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে এটি খাতের উত্তরোত্তর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের মূল চালিকা শক্তি। যদিও জিডিপিতে এ খাতের অবদান বড়, উদ্যোক্তারা ঋণ, প্রযুক্তি, দক্ষতা ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি।
এসএমই খাত শুধু নতুন ব্যবসা ও কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে না, বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে দেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে। এজন্য সরকার ও প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন, সহজ ঋণ, দক্ষতা উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং রফতানি-বান্ধব নীতিমালা নিশ্চিত করা জরুরি। সঠিক নীতি ও সহায়তা গ্রহণ করলে এসএমই খাত দেশের অর্থনীতি ও সমাজের জন্য বৃহত্তর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে।