বাংলাদেশ কয়েকটি দিক থেকে বিশ্বের অনন্য। এক. এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ বা ডেল্টা। দুই. জনসংখ্যার ঘনত্বে শহর দেশ সিঙ্গাপুর ও হংকং ছাড়া বাংলাদেশ এক নম্বরে। তিন. শস্য চাষের নিবিড়তায় দেশটি বিশ্বের শীর্ষে।
ক্রমহ্রাসমান জমি ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ গত পাঁচ দশকে বড় সাফল্য পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো, এটি সম্ভব হয়েছে কৃষকের মাঠে গবেষণার ফলাফল নানারকম প্রযুক্তি হিসেবে প্রয়োগ করার কারণে। ফলে দেশ নিত্যবছর দুর্ভিক্ষ এবং মঙ্গার আবহ থেকে মুক্ত হয়েছে। তবুও সমস্যা অব্যাহত আছে। দেশে এখনও এক-চতুর্থাংশের বেশি মানুষ ক্ষুধার্ত পেটে ঘুমোতে বাধ্য। উপযুক্ত নীতি এবং সময়োপযোগী কার্যক্রমে ব্যয় না হলে এই সংকট দিন দিন আরও গভীর হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
যদিও খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তার প্রতিটি সূচকেই বাংলাদেশের অতীত সাফল্য খুবই উজ্জ্বল, তবু আগামী দিনের খাদ্যনিরাপত্তায় বাংলাদেশ অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রমাগত আবাদি জমির হ্রাস, মৃত্তিকা স্বাস্থ্যের আশঙ্কাজনক অবনতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা জীবীয় ও অজীবীয় অভিঘাত। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজন সুপরিকল্পিত সমস্যাভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত জ্ঞান ও প্রযুক্তি যথাসময়ে কৃষকের মাঠে প্রয়োগ। জ্ঞান ও প্রযুক্তি বিস্ফোরণের এ যুগে আমাদের গতানুগতিক গবেষণা কৌশলে পারাডাইম শিফট এনে আউট অব দ্য বক্স থিংকিং চর্চার মাধ্যমে চলমান কৃষি বিবর্তনে নতুন গতি সঞ্চার করতে হবে। কৃষিকে একটি লাভজনক এন্টারপ্রাইজে রূপান্তরে অগ্রসরমাণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগের কোনো বিকল্প বাংলাদেশের নেই। এ প্রবন্ধে আগামী দিনের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তায় চ্যালেঞ্জগুলো এবং এদের মোকাবেলায় বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে অগ্রসরমাণ বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা ও আমার নিজস্ব মতামত তুলে ধরব।
এক. বর্তমান বিশ্বে কৃষি হচ্ছে জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে অগ্রসরমাণ শাখা। বিজ্ঞানের সবচেয়ে বিপ্লব সৃষ্টিকারী প্রযুক্তির গবেষণা এবং ফলাফল মাঠে প্রয়োগে কৃষি সবচেয়ে এগিয়ে আছে। যেমন ২০১২ সালে আবিষ্কৃত এবং ২০২০ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত ক্রিসপার-কাস জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা চলছে উদ্ভিদে। এরই মধ্যে এ যুগান্তকারী প্রযুক্তিটি ব্যবহারের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি উন্নত ফসলের জাত কৃষকের মাঠে এবং ভোক্তা পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারতসহ অনেক দেশের বাজারে চলে এসেছে। ফসলের উন্নত জাত উদ্ভাবন ছাড়াও এটি মাঠ পর্যায়ে উদ্ভিদের রোগ নির্ণয়ে সহজে ব্যবহারযোগ্য কিট আকারে ব্যবহারের প্রযুক্তি আমাদের ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি উদ্ভাবন করেছে, যা বিল গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে বিশ্বব্যাপী ব্যবহারের প্রকল্প চলমান আছে। ডিএনএ বা আরএনএভিত্তিক প্রযুক্তিটি এতটাই শক্তিশালী যে এটিকে যেকোনো জীবের যেকোনো রোগকে নিখুঁত ও দ্রুততার সাহায্যে নির্ণয় করা সম্ভব।
কৃষিতে বর্তমান শিল্প বিপ্লবের চালিকাশক্তি যেমন ন্যানো প্রযুক্তি, মেশিন লার্নিং, থ্রিডিপ্রিন্টিং, ব্লকচেইন, স্যাটেলাইট এবং ড্রোন ইমেজিং, স্যাটেলাইটভিত্তিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এসব প্রযুক্তি ক্লাইমেট স্মার্ট, বেশি উৎপাদনশীল এবং লাভজনক এক নয়া কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেছে। এসব সম্ভব হচ্ছে কৃষিতে বহুবিভাগীয় গবেষণা এবং জ্ঞানের প্রয়োগের ফলে। গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও কম্পিউটার বিজ্ঞানের অনেক গবেষণা যেমন জিনোমিক্স, প্রোটিওমিক্স, মেটাবোলোমিক্স, প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠন, প্রোটিন-প্রোটিন মিথস্ক্রিয়া গবেষণায় ন্যানো প্রযুক্তি, কম্পিটেশনাল বায়োলজি এখন সবচেয়ে বিকাশমান বিজ্ঞান। জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮-তে ন্যানো প্রযুক্তির প্রয়োগের উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে এ বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণা খুবই সীমিত। আধুনিক কৃষি গবেষণা এবং সম্প্রসারণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তা জোরদার করতে চাই দক্ষ জনশক্তি। সেজন্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে চাই আমূল পরিবর্তন। এজন্য একটি সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ আশু গ্রহণ করা প্রয়োজন।
দুই. যদিও বিশ্বব্যাপী কৃষিতে নানা অগ্রসরমাণ প্রযুক্তির সংযোজন চলছে, আমরা এক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে আছি। এর তিনটি কারণ এক. আমাদের দুর্বল গবেষণা অবকাঠামো; দুই. উচ্চ দক্ষতা মেধাসম্পন্ন মানবসম্পদের অভাব; তিন. গবেষণা ও উদ্ভাবনে পরিকল্পিত বিনিয়োগের অভাব। গবেষণায় বিনিয়োগে বাংলাদেশ বিশ্বে উগান্ডার প্রায় সমপর্যায়ের (জিডিপির দশমিক শূন্য ২৬ শতাংশের কাছাকাছি) যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন)। চার. আন্তর্জাতিক কোলাবরেশনের দুর্বলতা ও অভাব। পাঁচ. দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় পরিকল্পনা, অগ্রাধিকার নির্ণয় ও হালনাগাদ নীতি সিদ্ধান্তের অভাব। কৃষি হচ্ছে ফসল, পশুপাখি, মাৎস্য, বন, পরিবেশ ও আধুনিক অন্যান্য বিজ্ঞানের সমন্বিত বিজ্ঞান। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রণীত জাতীয় কৃষি নীতি মূলত একটি শস্য নীতি।
তিন. ফ্রান্সের দার্শনিক জ্যঁ-জ্যাক রুশো প্রায় ৩০০ বছর আগে বলেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং গৌরবমণ্ডিত শিল্প হচ্ছে কৃষি। হাজার হাজার বছর ধরে কৃষি মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এটি সত্য। স্বাধীনতার পর থেকে কৃষিবিদরা উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বহু গুণ বাড়িয়েছেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নিত্যনতুন জাত উদ্ভাবন করে খাদ্য উৎপাদনকে স্থিতিশীল রেখেছে। তবে বর্তমানে দেশ নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বন্যা, খরা, লবণাক্ততা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষিকে হুমকির মুখে ফেলছে। অন্যদিকে দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। এ পরিস্থিতিতে শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, বরং গুণগত মানসম্পন্ন ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি কৃষিপণ্যের উপকরণের খরচ বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে প্লাস্টিক দূষণ আমাদের খাদ্য শৃঙ্খল ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় পুরনো ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে অগ্রসর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
চার. মৃত্তিকার স্বাস্থ্যের সঙ্গে পৃথিবীর সব জীবের অস্তিত্ব ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত। নিবিড় শস্য চাষ এবং অপরিকল্পিত ও অতিরিক্ত রাসায়নিক ইনপুট ব্যবহারে আমাদের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ মৃত্তিকার স্বাস্থ্য ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন ভারী ধাতু এবং রাসায়নিক দূষণে মৃত্তিকা এমন এক সংকটজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এখন যেকোনো ইনপুট দিলেও তা আগের মতো সাড়া দিচ্ছে না। এ দূষণ আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মানব স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। মৃত্তিকা একটি জীবন্ত সত্তা, যেখানে কোটি কোটি অণুজীব মাটির উর্বরতা, উৎপাদনক্ষমতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী গ্রিনহাউজ গ্যাস চক্রায়নে কাজ করে। মৃত্তিকা স্বাস্থ্যের বড় নিয়ামক হচ্ছে মৃত্তিকা অণুজীব সমগ্র ।
প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে গত পাঁচ দশকে মূলত মৃত্তিকার অজৈব বৈশিষ্ট্যের অধ্যয়নই সীমিত থেকেছে। এখন নেক্সট জেনারেশন ডিএনএ সিকুয়েন্সিংয়ের ফলে আমরা মৃত্তিকা অণুজীবের পূর্ণাঙ্গ ম্যাপ তৈরি করতে সক্ষম। ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, এসআরডিআইয়ের বিজ্ঞানীদের সম্পৃক্ত করে ১৪টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের মৃত্তিকা মাইক্রোবায়োম ম্যাপিংয়ের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে, যা বিশ্বখ্যাত আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজির জার্নালে প্রকাশ হয়েছে।
এ কাজকে অগ্রসর করে দেশের মৃত্তিকা মাইক্রোবায়োম ম্যাপিং করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মৃত্তিকা মাইক্রোবায়োম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে আমাদের মৃত্তিকার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি। এটি দেশে টেকসই ও জলবায়ুবান্ধব কৃষির অন্যতম পদক্ষেপ হতে পারে। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে আফ্রিকায় মৃত্তিকা মাইক্রোবায়োম ম্যাপিং শুরু হয়েছে। এ কাজে আমাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও সামর্থ্য রয়েছে, প্রয়োজন আশু জাতীয়ভাবে একটি সমন্বিত উদ্যোগ। এছাড়া ভূমি ব্যবহার আইনের কঠোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষি জমিকে অকৃষি খাতে চলে যাওয়া বন্ধ করতে হবে।
পাঁচ. খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রথম এবং প্রধান ধাপ হলো পর্যাপ্ত উৎপাদন। এক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে কৃষি প্রযুক্তি, একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। জিনোম এডিটিং, বায়োটেকনোলজি এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং উচ্চফলনশীল, রোগ প্রতিরোধক এবং জলবায়ুর অভিঘাত সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ জৈব সোনা অর্থাৎ উপকারী অণুজীব এবং অন্যান্য অনন্য জেনেটিক কোডে সমৃদ্ধ একটি দেশ। একটি জাতীয় কমিশন্ড প্রকল্পের মাধ্যমে এ মূল্যবান জৈব সোনা আহরণ এখনই শুরু করা প্রয়োজন। এসব জৈব সোনা, যেমন উপকারী অণুজীব এবং অন্যান্য জীবে লুক্কায়িত জেনেটিক কোডগুলো উদ্ঘাটন করে ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার কমানো যেতে পারে।
এছাড়া বাংলাদেশ ন্যাশনাল জিনোম সিকোয়েন্সিং এবং ফাংশনাল জিনোমিক্স নামের একটি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য দেশে দ্রুত জিনোম এডিটিংয়ের মাধ্যমে ফসল, মৎস্য এবং প্রাণীর উন্নত জাত উদ্ভাবনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। CRISPR-Cas9-এর মতো জিন এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে খরা, লবণাক্ততা-সহিষ্ণু এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসলের জাত উদ্ভাবন সম্ভব। প্রতিবেশী দেশ ভারত এরই মধ্যে জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধানের দুটি উচ্চফলনশীল এবং জলবায়ু-অভিঘাত সহনশীল জাত অবমুক্ত করেছে। তাহলে আমরা কেন এ বিষয়ে কোনো জাতীয় উদ্যোগ দেখছি না?
ছয়. আধুনিক যুগে কৃষি শুধু বীজ ও সারের ওপর নির্ভরশীল নয়। নির্ভুল বা যথার্থ কৃষি ব্যবস্থায় সেন্সর, ড্রোন এবং উপগ্রহ চিত্রের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে কৃষকরা তাদের ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ, সারের চাহিদা এবং রোগ-বালাইয়ের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারেন। এটি কৃষিপণ্যের উপকরণের অপচয় কমায় এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং বিগ ডাটা ব্যবহার করে কৃষি-সংক্রান্ত সব তথ্য (মাটি, জলবায়ু, বাজার) একটি কেন্দ্রীয় প্লাটফর্মে একত্র করা যেতে পারে। এ প্লাটফর্ম কৃষকদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে, যেমন কোনো ফসল কোথায় চাষ করলে লাভ বেশি হবে, কখন বীজ বপন করতে হবে এবং বাজারে কোনো পণ্যের চাহিদা বেশি।
সাত. খাদ্য উৎপাদনের পর তার সঠিক প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ পুষ্টিনিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য ফর্টিফিকেশন (খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যোগ করা) একটি কার্যকর কৌশল। বাংলাদেশে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ চাল, আয়োডিনযুক্ত লবণ এবং ভিটামিন ‘ডি’ ও ‘এ’ সমৃদ্ধ ভোজ্য তেল বিতরণ করা হয়। পাশাপাশি বায়োফর্টিফিকেশন বা পুষ্টি সমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবনও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত জিঙ্কসমৃদ্ধ ব্রি ধান একটি সফল উদাহরণ, যা দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর জিঙ্কের অভাব পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আট. টেকসই কৃষি উন্নয়নের জন্য পরিবেশগত স্থায়িত্ব অপরিহার্য। প্লাস্টিক দূষণ আজ আমাদের খাদ্য শৃঙ্খল এবং স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। প্লাস্টিক বর্জ্য আমাদের জলাভূমি এবং মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে। এ সমস্যা মোকাবেলায় আইন প্রণয়নের পাশাপাশি বিকল্প উদ্ভাবনের ওপর জোর দিতে হবে। পাট থেকে তৈরি পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যবহারকে উৎসাহিত করা একটি ভালো সমাধান হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণের কারণে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ক্ষতি বছরে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পরিবেশবান্ধব কৃষি অনুশীলন, যেমন জৈব সারের ব্যবহার, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। এটিই আমাদের জৈব অর্থনীতির ভিত্তি। দেশীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং প্রযুক্তির সমন্বয়ে এক নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির সূচনা হবে, যা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে এক নতুন অবস্থানে নিয়ে যাবে।
সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে আরো বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং তা কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন অপরিহার্য। কৃষি, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং আইসিটি—এ মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বিত নীতি সহায়তা অত্যন্ত জরুরি। একটি সুসমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে টেকসই খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তার এ যাত্রাকে কেবল একটি কৃষি বিপ্লব নয়, বরং এটি একটি বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বিপ্লবের গল্প। উন্নত বীজ থেকে শুরু করে ড্রোন, এআই থেকে খাদ্য ফর্টিফিকেশন—প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ছোঁয়া সুস্পষ্ট। যদিও উচ্চ খরচ, জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব, এবং নীতিগত দুর্বলতার মতো চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান, বাংলাদেশ এরই মধ্যে প্রমাণ করেছে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে তার জনগণের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার সক্ষমতা তার রয়েছে। কৃষি আমাদের সংস্কৃতি। কৃষি ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যের জ্ঞাননির্ভর কৃষি এক নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। পরিকল্পিত ও সুসমন্বিত সময়োচিত পদক্ষেপ এবং দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ কেবল তার নিজস্ব খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তাই টেকসইভাবে অর্জন করবে না, বরং বিশ্বের জন্যও একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফেলো, বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমি। সূত্র: বনিক বার্তা